শিক্ষক বদলি নিয়ে কতিপয় প্রস্তাব

মো. মাহাতাব আলী |

আগামী ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাণের দাবি বদলির কর্মশালা। শোনা যাচ্ছে এই কর্মশালার পর বদলির খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হবে। 

আমি মনে করি-সমস্যা যাদের তাদেরকে নিয়েই সমস্যা সমাধান করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বদলি প্রত্যাশি শিক্ষক কর্মচারীদের লিখিত মতামত বা প্রস্তাব নিয়ে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মতামতের ভিত্তিতে বদলির নীতিমালা তৈরি করা উচিত। ফেসবুকে উঁকি মারলেই দেখা যায় শিক্ষকদের তৈরি বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপে বদলি নিয়ে বিভিন্ন রকমের লেখা।

কিসের ভিত্তিতে বদলি বাস্তবায়ন হবে?

তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুকে অনেক জল্পনা-কল্পনা এবং আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কারণ, বাস্তবিক অর্থেও বদলি কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বিগ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে এনটিআরসিএ-এর সনদ। 

কারণ, কেউ কেউ চান যে এনটিআরসিএ-এর সনদের ভিত্তিতে বদলি হোক। আবার কেউ কেউ চান এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে যাদের নিয়োগ শুধু তাদের বদলি হোক। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীর এনটিআরসিএ-এর সনদ নেই। আবার যাদের সনদ আছে তাদের মধ্যে সবার নিয়োগ এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে হয়নি। এনটিআরসিএ-এর সনদধারীদের সিংহ ভাগই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ, বাকি অল্প সংখ্যক শিক্ষক এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে নিয়োগ। এ নিয়েই বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে নানা ধরনের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখা দিয়েছে।

বদলি বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের একটি দীর্ঘদিনের এবং বহুল আকাঙ্ক্ষিত দাবি। সুতরাং প্রক্রিয়াটি বদলি প্রত্যাশি শিক্ষক-কর্মচারীদের গ্রহণযোগ্য মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।

মূলত দূরত্ব, স্বল্প বাড়িভাড়া (মাত্র ১ হাজার টাকা) আত্মীয় স্বজনদের ছেড়ে স্থায়ীভাবে দূরে অবস্থান করা এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বদলির দাবি প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক বার রাজধানীতে মানববন্ধন এবং বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে বাড়ি থেকে দূরদূরান্তে কর্মরত শিক্ষকরা।  

বদলি বাস্তবায়ন করা এবং বদলিতে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একজন বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক হিসেবে বদলি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সমস্যা ও সমস্যা সমাধানে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি। 

বিভিন্ন সমস্যা এড়াতে বদলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে মোট ৫০ নম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরধারীকে বদলিতে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব তুলে ধরা হলো: 
নম্বর বিভাজন: ১. দূরত্ব= ২০ নম্বর ২. মেধা= ১৫ নম্বর ৩. বয়োজ্যেষ্ঠতা= ১৫ নম্বর

১. দূরত্বে ২০ নম্বর: যেহেতু দূরত্বের কারণেই বদলি প্রয়োজন তাই বদলির ক্ষেত্রে প্রথমত দূরত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। একই উপজেলার প্রার্থী হলে ১ নম্বর, আলাদা উপজেলার প্রার্থী হলে ৫, আলাদা জেলার প্রার্থী হলে ১০, আলাদা বিভাগের প্রার্থী হলে ২০ নম্বর বিবেচনা করা যেতে পারে। আবার প্রতি ৫০+ কিলোমিটারের জন্য ১ নম্বর, ১০০+ কিলোমিটারের জন্য ২, ২০০+ কিলোমিটারের জন্য ৪, ৩০০+ কিলোমিটারের জন্য ৬, ৪০০+ কিলোমিটারের জন্য ৮, ৫০০- ৮০০+ কিলোমিটারের জন্য ১০ এবং ৯০০+ কিলোমিটারের জন্য ১৮ নম্বর বিবেচনা করা যেতে পারে। 

২. মেধার ক্ষেত্রে ১৫ নম্বর: এসএসসি সনদে ৩ নম্বর অর্থাৎ প্রথম বিভাগ/জিপিএ ৩.০০+= ৩ নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ/জিপিএ ২.০০+=২ নম্বর, তৃতীয় বিভাগ/জিপিএ ১.০০+=১ নম্বর ধরা যেতে পারে। আবার এইচএসসি সনদে ৩ নম্বর অর্থাৎ প্রথম বিভাগ/জিপিএ ৩.০০+=৩ নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ/জিপিএ ২.০০+=২ নম্বর, তৃতীয় বিভাগ/জিপিএ ১.০০+=১ নম্বর হতে পারে। একইভাবে স্নাতক/ডিগ্রি পাস সনদে ৩ নম্বর, প্রথম বিভাগ/সিজিপিএ ৩.০০+=৩ নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ/সিজিপিএ ২.০০+=২ নম্বর, তৃতীয় বিভাগ/সিজিপিএ ১.০০+=১ নম্বর হতে পারে। বিএড/এমএড সমমান সনদে ৩ নম্বর। অর্থাৎ প্রথম বিভাগ/জিপিএ ৩.০০+=৩ নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ/জিপিএ ২.০০+=২ নম্বর, তৃতীয় বিভাগ/জিপিএ ১.০০+=১ নম্বর। আবার স্নাতকোত্তর/এমবিএ/উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ৩ নম্বর। অর্থাৎ প্রথম বিভাগ/সিজিপিএ ৩.০০+=৩ নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ/সিজিপিএ ২.০০+=২ নম্বর, তৃতীয় বিভাগ/সিজিপিএ ১.০০+=১ নম্বর 
মেধার ক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষা জীবনের অর্জিত সকল সনদকে প্রাধান্য দিতে হবে। শুধুমাত্র এনটিআরসিএ-এর একটি সনদ দ্বারা মেধা যাচাই করা যায় না। তা ছাড়া, ইনডেক্সধারী সকল শিক্ষকের এনটিআরসিএ-এর সনদ নেই। তাই শুধুমাত্র এনটিআরসিএ-এর সনদ অনুযায়ী বদলি বিবেচনা করলে বদলির নামে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হবে এবং এই বদলি সর্বজনীন না হয়ে গুটিকয়েক নবাগত শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। সুতরাং, বদলি ব্যবস্থাকে সার্বজনীন করতে এনটিআরসিএ-এর সনদের পরিবর্তে শিক্ষা জীবনের অর্জিত সকল সনদ অনুযায়ী বদলি বিবেচনা করতে হবে।  

৩. বয়োজ্যেষ্ঠতার ক্ষেত্রে ১৫ নম্বর: চাকরির বয়স ২-৫ বছর হলে ৫ নম্বর, চাকরির বয়স ৫-১০ বছর হলে ১০, চাকরির বয়স ১০+ হলে ১৫ নম্বর বিবেচনা করা হবে।
আনুষঙ্গিক বিষয়: ক. বদলি ব্যবস্থা শিক্ষক-কর্মচারী সবার জন্য সর্বজনীন করতে হবে (যাদের বদলি প্রয়োজন তাদের সবার জন্য)। খ. বদলিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সভাপতির কর্তৃত্ব রাখা যাবে না তাহলে হয়রানি এবং ঘুষ প্রথা চালু হবে। গ. প্রতিবছর গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্বে ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বদলি বাস্তবায়ন করার পর শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারীদের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সমস্ত শূন্য পদে নতুনদের নিয়োগ দিতে হবে। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে বদলির গণবিজ্ঞপ্তি না দিলে বদলির কোনোই মূল্য থাকবে না।
ঘ. চাকরির বয়স কমপক্ষে ২ বছর পূর্ণ হলে বদলির যোগ্য বিবেচিত করতে হবে, ২ বছর পূর্ণ না হলে বদলির জন্য বিবেচিত হবে না।
ঙ. শিক্ষক ছাড়া অন্যান্য কর্মচারীদের দূরত্ব এবং বয়োজ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বদলি দিতে। সনদ অনুযায়ী নয়। 

বদলি ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করতে উল্লেখিত নম্বর বিভাজন সফটওয়্যারের মাধ্যমে অথবা ম্যানুয়ালি করা সম্ভব। সমপদে বদলি প্রত্যাশীদের আবেদনের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বরধারীকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রার্থীকে বদলির জন্য নির্বাচন করলে এটি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য বদলি বলে বিবেচিত হবে। 

প্রস্তাব এবং জনমত যাচাই: আমার মতামতকে গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমার মত শত শত বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকের মতামত নিয়ে অধিক যুক্তিসঙ্গত মতামতের ভিত্তিতে বদলির নীতিমালা তৈরি করতে হবে। 

একাধিক মতামত গ্রহণ করে সেই মতামতকে কতজন সমর্থন করছে সেটার ব্যাপারে জনমত যাচাই করে বদলির নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যদি মতামত না পাওয়া তাহলে আমার প্রস্তাবকেও জনমতের জন্য যাচাই করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক- কর্মচারীদের অধিকাংশই এই প্রস্তাবনাকে সমর্থন করবে।

বদলির জন্য আর বিলম্ব নয়। কারণ, যুগের পর যুগ এমপিও ভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বদলির জন্য অপেক্ষা করছে। একই উপজেলার মধ্যে মেধা কোটায় নিয়োগ পেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি বদলি থাকে তাহলে সারাদেশের মধ্যে জাতীয় কোটায় নিয়োগ পেয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি বাস্তবায়ন হবে না কেনো?

আমরা অতিসত্বর এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইনডেক্সধারী শিক্ষক কর্মচারীদের বদলির বাস্তবায়ন দেখতে চাই। 

আগামী ৩০ জানুয়ারি বদলির কর্মশালা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেই ফেব্রুয়ারি মাসে ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির গণবিজ্ঞপ্তি চাই। ফেব্রুয়ারি মাসেই বদলি বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে মার্চ মাসে ৫ম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এপ্রিল মাসের মধ্যেই নিবন্ধন সনদধারী প্রার্থীদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দিতে হবে। সময়ের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা যাবে না। এই কালক্ষেপণের কারণে বহু নিবন্ধন সনদধারী প্রার্থীদের বয়স ৩৫+ হয়ে চাকরি বঞ্চিত হচ্ছেন যা আমাদের কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ

[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে দৈনিক আমাদের বার্তার সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে]

 

  

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে - dainik shiksha একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের - dainik shiksha ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম - dainik shiksha থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান - dainik shiksha প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037930011749268