শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে তিন বিশ্ববিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন শিক্ষক থাকবেন। জাতীয় পর্যায়েও দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এ মানদণ্ড অনুসরণে উৎসাহিত করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। যদিও সে লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির তথ্য বলছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)।

উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে বিভাগ খোলা, শিক্ষক নিয়োগে কর্তৃপক্ষের গড়িমসি ও উচ্চধাপের পদগুলোয় জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না পাওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সদস্য এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, অনুমোদিত অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী শিক্ষার্থী অনুপাতে যে সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন, ইউজিসির পক্ষ থেকে সে পদগুলো সৃষ্টি করে দেয়া হয়। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়ার কারণে এতে বিলম্ব দেখা যায়। এছাড়া নিয়োগ নিয়ে অনেক কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে গড়িমসি করা হয়। এছাড়া বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের মতো জ্যেষ্ঠ মর্যাদার পদগুলোয় নিয়োগ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক পাওয়া যায় না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে থাকার এটিও একটি বড় কারণ। শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নয়, প্রতি ক্লাসে বা শিফটে সর্বোচ্চ কতজন শিক্ষার্থী থাকবেন, উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতে সেটিও নির্ধারণ করে দেয়া প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রতি বছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইউজিসি। কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য বলছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ হাজার ৩৯৩ জন। এসব শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৮৮ জন। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৪৪। অর্থাৎ প্রতি ৪৪ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন একজন করে, যা বৈশ্বিক ন্যূনতম মানদণ্ড এমনকি জাতীয় পর্যায়ের গড় অনুপাত থেকেও অনেক বেশি। 

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বেরোবির পরের অবস্থানে রয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮ হাজার ২৯১ জন। শিক্ষক রয়েছেন ১৯৩ জন। সে হিসেবে এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত দাঁড়ায় ১:৪৩।

পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় এর পরের অবস্থানে রয়েছে গোপালগঞ্জের বশেমুরবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০ হাজার ৯৮৯ জন। আর শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২৭২ জন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪০। বিশ্ববিদ্যালয়টির তিনটি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউটের নিজস্ব কোনো শিক্ষকই নেই। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বশেমুরবিপ্রবির একজন শিক্ষার্থী বলেন, মূলত একের পর এক নতুন বিভাগ খোলা ও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ শিক্ষক সংকট তৈরি হয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস টেস্ট, প্রেজেন্টেশন তুলনামূলক কম নেয়া হয় এবং আমরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় দক্ষতার দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকি। এছাড়া পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় আমরা পরীক্ষার ফলাফলও সঠিক সময়ে পাই না।

করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে কয়েক মাস আগে বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য পদে যোগ দিয়েছেন ড. একিউএম মাহবুব। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে এসে দেখলাম, কয়েক বছরে একাডেমিক ও রিজেন্ট কমিটির সভা হয়নি। তাহলে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার তো কোনো সুযোগই নেই। দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষক সংকটসহ একাডেমিক সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করছি। বেশ কয়েকটি বিভাগের ফলাফল প্রকাশের ব্যবস্থা করেছি। আর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, অনেকেই জেলা পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র পোস্টে আসতে চান না। এজন্য আমরা ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের চুক্তিভিত্তিক বা সম্ভবপর অন্য কোনো উপায়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে রয়েছে পুরনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও। এমনই এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি। আর শিক্ষক রয়েছেন ৩৯৯ জন। সে হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত দাঁড়ায় ১:৩৮। বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অপরিকল্পিতভাবে বিভাগ খোলার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত কয়েক বছরে বেশকিছু বিভাগ খোলা হয়েছে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই। নতুন বিভাগ খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। অথচ তাদের পাঠদানের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। এমনকি শ্রেণীকক্ষও তৈরি করা হচ্ছে না।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় রয়েছে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও (হাবিপ্রবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী রয়েছেন ১১ হাজার ৫৪৭ জন। শিক্ষক রয়েছেন ৩১২ জন। সে হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত দাঁড়ায় ১:৩৭।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শূন্য পদগুলোয় শিক্ষক নিয়োগ না দেয়াকেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে থাকার কারণ বলে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ড. মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী যে-সংখ্যক শিক্ষক থাকার কথা, তার অর্ধেক পরিমাণ শিক্ষকও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে পড়েছে হাবিপ্রবি। আসলে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োজিত না থাকলে গুণগত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025601387023926