দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক : ২০২০ শিক্ষাবর্ষে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে দুটি ‘ট্রেডে’ ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা’ চালু হয়েছে। ট্রেড দুটি হলো- 'জেনারেল ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কস' (জিইডব্লিউ) ও 'কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি' (সিআইটি)। চার শিক্ষাবর্ষ গেলেও ওই বিদ্যালয়ে দুই 'ট্রেডে' কোনো শিক্ষক বা 'ইনস্ট্রাক্টর' নিয়োগ দিতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসন। মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, প্রতি শিক্ষাবর্ষেই অন্তত ৩৮ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী ওই দুটি 'ট্রেড' বেঁচে নিচ্ছেন বলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রাম মোহন জানিয়েছেন।
শিক্ষক ছাড়া কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান হচ্ছে- জানতে চাইলে রাম মোহন বলেন, 'সরকার যেহেতু ট্রেড চালু করেছে; আমাদের তো পড়াতেই হয়। সাধারণ শিক্ষক ও খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছি।'
সাধারণ শিক্ষকরা কীভাবে এই 'বিশেষ ট্রেডে' পড়ান এবং খণ্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন কীভাবে যোগান দেয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সাধারণ শিক্ষকরা কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন; আর খণ্ডকালীন শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন দেয়া হচ্ছে।'
কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের ৫২টি পদের মধ্যে অন্তত ১৫টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে বলে প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিদ্যালয়টির স্বাভাবিক শিক্ষাক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলেও একজন শিক্ষক জানিয়েছেন।
২০২০ শিক্ষাবর্ষে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ সারাদেশের মোট ২০টি সরকারি এবং ৬২০টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে 'দুটি' করে দশটি 'ট্রেডে' (বিষয়) বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি বিদ্যালয়ে একজন করে 'ইনস্ট্রাক্টর' নিয়োগ পেলেও ২০টি সরকারি এই বিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ওই দশ ট্রেডে একজন শিক্ষক বা ইনস্ট্রাক্টরের পদও সৃষ্টি হয়নি। কোনো শিক্ষক নিয়োগও পায়নি।
'সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম'র (সেসিপ) আওতায় সাধারণ বিদ্যালয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা' চালু করা হয়েছে। সরকারি ২০ বিদ্যালয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন সেসিপের যুগ্ম প্রোগ্রাম পরিচালক অধ্যাপক ড. ই শামছুন নাহার। তিনি বলেন, বেসরকারি বিদ্যালয়ের জনবল কাঠামোর ভোকেশনাল শিক্ষার জন্য ২ জন ট্রেড কইনস্ট্রাক্টর ও ২ জন ট্রেড অ্যাসিস্টেন্টের পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সেসিপের ভোকেশনাল কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ৮৯টি মাদরাসায় বর্ণিত ৪টি পদ সৃজন করা হয়েছে। কিন্তু ২০টি সরকারি বিদ্যালয়ে পদ সৃজন না হওয়ায় একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
সেসিপ থেকে জানা গেছে, ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় সৃষ্ট ১০টি ট্রেডের প্রতিটিতে ৪০ জন করে মোট ৫১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ থাকলেও ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এটি মোট আসন সংখ্যার ৪৪ শতাংশ মাত্র। সেই হিসেবে ৫৬ শতাংশ আসনই ফাঁকা।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুটি করে 'ল্যাব নির্মাণপূর্বক আন্তর্জাতিক মানের মূল্যবান যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আসন অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ায় সরকারি সম্পদের 'অপচয়' হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় 'দক্ষ নাগরিক তৈরির কার্যক্রম ব্যাহত' হচ্ছে বলে সেসিপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
দুটি ট্রেডে শিক্ষার্থী ভর্তি নিশ্চিত করতে মাউশির আঞ্চলিক পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে সেসিপ কর্তৃপক্ষ। ড. শামছুন নাহার এসব ট্রেডে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ভোকেশনাল শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সম্পৃক্ত করে 'সচেতনতামূলক প্রচারণা' চালানোর উদ্যোগ নেয়ার জন্য 'বিশেষভাবে' অনুরোধ জানান।
'জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের' (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে সংস্থাটি শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না। কোথাও কোথাও 'বৃত্তিমূলক শিক্ষা'র ট্রেড পড়াতে সাধারণ বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশও করছে।
২০২০ শিক্ষাবর্ষে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইলের চুন্টা এসি একাডেমি উচ্চ বিদ্যালয়ে 'ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন' এবং 'রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং' ট্রেড চালু হয়েছে। এই বিদ্যালয়ে দুটি ট্রেডেই বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলেও কোনো শিক্ষক নেই বলে জানিয়েছেন পরিচালনা পরিষদের সদস্য জিয়াউর রহমান।
তিনি বলেন, দুটি ট্রেডে শিক্ষক দেয়ার জন্য এনটিআরসিএতে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা থেকে 'অন্য বিষয়ের' (সাধারণ বিষয়) শিক্ষক পাঠায়। এ কারণে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়নি। সম্প্রতি বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্তে নিজস্ব উদ্যোগেই দুটি ট্রেডে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে বলে জানান জিয়াউর রহমান। মাউশির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতির আলোকে সাধারণ ধারার মাধ্যমিক স্কুলে কারিগরি শিল্প, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। কিন্তু এসব ট্রেডে প্রয়োজনীয় শিক্ষক হয়নি। এমনকি এ সংক্রান্ত শিক্ষা উপকরণ পরিচালনার জন্য জনবলও নিয়োগ হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে নবম শ্রেণীতে 'বৃত্তিমূলক শিক্ষা'চালু করার সময় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিতে দুই শ্রেণীতে (নবম ও দশম) ন্যূনতম দুইজন শিক্ষক ও দুইজন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট আবশ্যক। চার শিক্ষাবর্ষ অতিবাহিত হলেও সবকটি বিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ট্রেডভিত্তিক শিক্ষকই নিয়োগ হয়নি: ল্যাব অ্যাসিসটেন্টও নিয়োগ দেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে 'বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতি'র সভাপতি অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, সরকার কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে। সেই আলোকেই ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে 'বৃত্তিমূলক শিক্ষা' চালু করা হয়েছিল। কিন্তু উদ্যোগটি 'মুখ থুবরে পরে আছে। কোনো কিছুই এগুচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগে 'প্রতিবন্ধকতার' কারণ খুঁজে বের করার দাবি জানিয়ে এই শিক্ষক নিতো বলেন, 'যাদের কারণে এই সংকট তৈরি হলো, কারা বাধা দিচ্ছেন এবং জন কী কী কারণে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া দি যাচ্ছে না তা খোঁজে বের করা উচিত।' বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের পদ খালি রেখে, অবকাঠামোর ঘাটতি রেখে এবং সাধারণ শিক্ষা ধারার শিক্ষক দিয়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হবে না বলে মনে করেন শাহজাহান আলম সাজু।
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। এছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, লেদার ইনস্টিটিউটসহ এ ধরনের অন্যান্য ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।