শিক্ষক সমাজ এবং আমরা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘শিক্ষক হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে যুগ যুগান্তরে সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তান্তরিত করেন কিন্তু কুসংস্কার, দোষ ও অজ্ঞতাকে ওদের হাতে তুলে দেন না’। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের এমন ভাবতেন। শিক্ষকদের কাছে সারাবিশ্বের মানুষের মতো আমাদেরও চাহিদা তারা নতুন প্রজন্মকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলবেন। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে সৃজনশীল, প্রয়োগমুখী ও উত্পাদন সহায়ক করে তোলা, শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়তা প্রদান করা’-কে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষক সমাজ জাতির এ প্রত্যাশা পূরণে প্রচেষ্টারত। কিন্তু শিক্ষক সমাজের প্রচেষ্টাকে নিয়ে সমাজে নানামত রয়েছে। রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, দেশে একসময় প্রকৌশলীদের বলা হতো মিস্টার টেন পারসেন্ট। উন্নয়নের সিংহভাগ অর্থ এই পেশাজীবীদের মাধ্যমে ব্যয়িত হয়ে থাকে। সেই উন্নয়ন কার্যক্রমের জীবনকাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বহু প্রশ্ন থাকায় প্রকৌশলীরা এভাবে সমালোচিত হতো। অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও সমালোচনার জোর এখন কমে গিয়েছে। এক এক সময় এমন সমালোচনার জোয়ারে ভেসে চলে দেশের চিকিত্সক সমাজ। দেশের সাধারণ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা চিকিত্সা বাণিজ্যের কাছে পরাজিত হলেও উচ্চমহলের বিদেশে চিকিত্সা নিশ্চিত থাকায় পরিবেশের কোনো উন্নতি নেই। এমনভাবে সময়ে সময়ে পেশাজীবীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠলেও সময়ের ব্যবধানে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং নতুন আর এক পেশাজীবীদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে দেশে শিক্ষক সমাজ নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে।

আমাদের শিক্ষক সমাজের সব থেকে সম্মানের স্থান বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ সাধারণ মানুষকে ভাবায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ভূমিকা শিক্ষক সমাজকে আরো অনেক বেশি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। সৌম্য চেহারার জ্ঞান তাপসরা নিজেরাই ঝাপসা করে চলেছেন। বহু অভিযোগ আছে যার তালিকা দিলে লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে।

দেশের শিক্ষক সমাজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিক নয়। সরকার শিক্ষার উন্নয়নে প্রতিদিনই নতুন নতুন নীতি-কৌশল ঘোষণা করে চলেছেন। নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে, মিডডে মিলের ব্যবস্থা করছে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে পড়ানো শুরু করেছে, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছে, শিক্ষার্থীদের পোশাক সরবরাহে উদ্যোগী হয়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন করে পরিবেশের উন্নতি করছে, শিক্ষার্থীদের শতভাগ পাশের ব্যবস্থা করেছে। শিক্ষকদেরও অবস্থান ও বেতন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, শূন্যপদ পূরণের প্রচেষ্টা করছে, বায়োমেট্রিক হাজিরার ব্যবস্থা করেছে, কোচিং নীতিমালা করেছে, কোচিং সেন্টার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে, গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, জাতিকে শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। উপহারের পর উপহার হিসেবে জাতি পাচ্ছে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করা হয়েছে।

সরকার গৃহীত নীতি কৌশলের সঙ্গে শিক্ষক সমাজের সংশ্লিষ্টতার চেয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি। প্রতি ক্ষেত্রে ওপর মহল থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রকৃত সংশ্লিষ্টদের মতামতকে উপেক্ষা করার কারণে জনকল্যাণের নীতি কৌশল বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পেশার মানোন্নয়নে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ ও মটিভেশন যথাযথ হয় না। একজন জীবনব্যাপী এনালগ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থেকে উঠে আসা শিক্ষককে ৭/১০ দিনের প্রশিক্ষণে ডিজিটাল করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক থেকে সৃজনশীল চালু না করে নবম শ্রেণি থেকে তা চালু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পরিবেশের সঙ্গে সহঅবস্থান করতে শেখানোও সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থার সকল সাধু উদ্যোগ আজ নোট-গাইড-কোচিংয়ের মধ্যে একাকার হয়ে গিয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অবজ্ঞা না করে তাদের সঙ্গে নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে আজ বলতে হতো না দেশের অর্ধেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী সৃজনশীল বুঝে না।

দেশের পেশাজীবীদের ওপর দায় চাপানো খুব সহজ কাজ। একজনের ওপর দায় চাপালে নিজেকে দায়মুক্ত রাখা যায়। কিন্তু দায় চাপানোর আগে দেশের, সমাজের, ব্যক্তির আর্থসামাজিক পরিবেশ নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। দেশের অবস্থা কী, সমাজ কোন পথে চলেছে এবং ব্যক্তি ভাবনা বিবেচনার দাবি রাখে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ, মোসাহেবি ইত্যাদির কাছে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা সর্বক্ষেত্রে পরাজিত। এই পরিস্থিতি থেকে উঠে এসেছে ব্যক্তি জীবনের অর্জন বিসর্জন দিয়ে পদ-পদবি প্রাপ্তির আগ্রহ। পেশাজীবীদের আরো উত্সাহিত করেছে রাজনৈতিক মতাদর্শিক বিভক্তি। যা পেশার উন্নয়নকে চরমভাবে বিপদগামী করেছে।

দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পুলিশ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি সকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল লক্ষ্য শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে যার যার দায়িত্বের প্রতি সচেতন থাকতে পারছেন না। রাজনীতিতে দেখা যায় রোদপোড়া শরীর আর জীর্ণবেশ নিয়ে যাত্রা শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই শরীর চকচকে হয়ে যাচ্ছে। প্রতি নির্বাচনে দেওয়া হলফনামার পরিবর্তন তা-ই প্রমাণ করে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ভেজাল মিশিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে শরীর চকচকে করছে। প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাত্ করে শরীর চকচক করছে। চিকিত্সকরা হাসপাতাল ফাঁকি দিয়ে ওষুধ কোম্পানি আর বেসরকারি ক্লিনিকের কমিশন নিয়ে শরীর চকচক করছে। শিক্ষকরা ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে কোচিং বাণিজ্য করে ও প্রাইভেট পড়িয়ে শরীর চকচকে করছে। আমলা, পুলিশ ইত্যাদির সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানি আর প্রতারণার শিকার হওয়ায় এদের শরীরও চকচকে হচ্ছে। পেশাজীবীদের মধ্যে উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে শরীর চকচকে করার একটা প্রতিযোগিতা জোর কদমে চলেছে। সেখানে যে কোনো একটা পেশার প্রতি অন্যদের সমালোচনা কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিবেচনার দাবি রাখে।

সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে পেশাজীবীদের চরিত্র হনন করে লাভ হবে না। পেশাজীবীদের রাজনৈতিক বিভক্তি বন্ধ করা জরুরি। আমাদের দেশে যে হানাহানি-কাড়াকাড়ির রাজনীতি চলমান তাতে একজন শিক্ষক অন্য মতাদর্শের শিক্ষার্থীর প্রতি নিরপেক্ষ থেকে শিক্ষা দেবে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। সব পেশাজীবীদের সংশ্লিষ্টতায় সমস্যা সমাধানের নীতি কৌশল গ্রহণ করা হোক। দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসন সাজানো হোক। পুরস্কারের প্রশিক্ষণ নয়, দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ প্রকৃতজনদের জন্য নিশ্চিত করা হোক। যার যার দায়িত্বের প্রতি তাদের সচেতন করা হোক। সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকলের বোধোদয় হোক। এতেই সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। সফল হবে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন।

লেখক : এম আর খায়রুল উমাম, প্রাবন্ধিক, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053248405456543