শিক্ষক সম্মেলন পেশাগত উন্নয়নের একটি প্ল্যাটফর্ম

মাছুম বিল্লাহ |

আমরা সবাই শিক্ষার কথা বলে থাকি। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও উন্নয়নের কথা বলে থাকি। কিন্তু পেশাগত উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক ও অবিরত প্রক্রিয়া। এটি এমন বিষয় নয় যে শুধু এক সপ্তাহের কিংবা দুই সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাম তো পেশাগত উন্নয়ন ঘটে গেল। পেশাগত উন্নয়ন জীবনব্যাপী ঘটে থাকে। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষক বা শিক্ষা সেমিনার বা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা পেশাগত উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ ধরনের সম্মেলন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেয় সর্বশেষ শিক্ষাগত উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে এবং সব ধরনের শিক্ষকের মধ্যে গড়ে তোলে এক চমৎকার সেতুবন্ধ, যেটি পেশাগত উন্নয়নের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের ভূমিকা, যথাযথ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি অনুশীলন, আইসিটির ব্যবহার ও পেশাগত উত্কর্ষ সাধনের নানা দিক তুলে ধরার একাডেমিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় একেকটি শিক্ষক বা শিক্ষা সম্মেলন।

পৃথিবীতে নতুন নতুন ধারণা, পদ্ধতি ও বিষয়ের প্রকাশ ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। একজন আধুনিক ও সফল শিক্ষককে এগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। কারণ আমাদের শিক্ষার্থীরা একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষার্থী। তারা আমাদের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে আছে তথ্য-প্রযুক্তিসহ নানা দিক দিয়ে। ইন্টারনেটের ব্যবহার গোটা বিশ্বকে আমাদের পড়ার টেবিলে এনে দিয়েছে; আর এর বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। অতএব, শ্রেণিকক্ষে তাদের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য আমাদের তাদের চেয়ে এসব বিষয়ে বেশি অবগত হতে হবে; তা না হলে তারা আমাদের পাঠদানে মনোযোগী হবে না। শিক্ষাসংক্রান্ত সেমিনার বা কনভেনশনে এসে শিক্ষকরা পরিচত হতে পারেন কোন শিক্ষক কী করছেন, কিভাবে করছেন, কিভাবে সমস্যার সমাধান করছেন, কিভাবে সীমিত সম্পদ ও হাজার সমস্যার মধ্যেও কার্যকর উপায়ে শিক্ষাদান করছেন ইত্যাদি। এগুলো শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করা যায় না।

ফিডব্যাক দেওয়া ও নেওয়া পেশাগত উন্নয়নের একটি প্রধান চাবিকাঠি। আমরা এ বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কারণ এটি আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলে বিষয়টি জানা যায়। আমরা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করার পর আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে কথা বলার আর কেউ নেই, তাই আমরা বিষয়টিতে অভ্যস্ত নই। আমরা ভাবি, আমরা যা পড়াচ্ছি, তা-ই ঠিক। আমার একটি সেমিনারে উপস্থাপনার বিষয় ছিল ‘সংবাদপত্রের মাধ্যমে কিভাবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা শেখানো যায়’, অর্থাৎ সংবাদপত্রকে একটি ভালো টিচিং ম্যাটেরিয়ালস হিসেবে শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করা যায়। সংবাদপত্র হচ্ছে একটি লিভিং ডকুমেন্ট ও কারেন্ট টেক্সটবুক। আমাদের টেক্সটবুক অনেক আগের তৈরি, অথচ পৃথিবীর পরিবর্তন হয় প্রতিদিন। আমাদের চারপাশের সর্বশেষ ঘটনাবলির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব থাকে শিক্ষার্থীরা। তাদের আগ্রহকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমরা সংবাদপত্রকে শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করতে পারি টেক্সট বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে। এটি অনেকেই প্রশংসা করেছেন, আবার কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁরা বলছেন, সংবাদপত্রে অনেক ভুল ভাষা ব্যবহার করা হয়, কাজেই শিক্ষার্থীদের জন্য তা ব্যবহার করা ঠিক নয়। মোটামুটি একটি ডিবেট। সেখানেও রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়, কিভাবে এগুলো মোকাবেলা করতে হয়। কিভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা মূল বিষয়গুলো দর্শকদের জানাতে পারি তাদের বিরক্তি না জাগিয়ে। এটি একটি চমৎকার স্কিল।

একজন তরুণ ছাত্রজীবন থেকে সবেমাত্র পেশায় প্রবেশ করেছেন। দেখলাম একটি সেমিনারে তিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ‘সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলিং’ দরকার। মানুষের মানসিক সমস্যা ৭০-৮০ শতাংশ সাধারণ কার্যাবলির দ্বারা ভালো হয়, ২০-৩০ শতাংশ কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়, তাদের মধ্যে ৫ শতাংশের জন্য ডাক্তার প্রয়োজন। তরুণ উপস্থাপক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থীর সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলিংয়ের জন্য শিক্ষকরাই উপযোগী, শিক্ষকরাই পারবেন এই বিশাল চাহিদা মেটাতে। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের শিক্ষকদের পেশাগত উত্কর্ষ সাধনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তরুণের চমৎকার উপস্থাপনা উপস্থিত অনেককেই মুগ্ধ করেছে। বিশাল একটি শিক্ষণীয় বিষয় এখানে লুক্কায়িত ছিল, যা অংশগ্রহণকারীরা শিখতে পেরেছেন। কাজেই এ ধরনের সম্মেলনে শিক্ষকদের বেশি বেশি অংশগ্রহণ প্রয়োজন। ওই তরুণের কাছে আমি চমৎকার সময় ব্যবস্থাপনা শিখেছি। দেখলাম তিনি তাঁর বরাদ্দ করা সময়ের মধ্যে তাঁর বিষয়ের সব কিছুই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন ধরনের দর্শকের সামনে।

প্রথমত, শিক্ষকরা নিজেদের এলাকায় ছোটখাটো সেমিনারের আয়োজন করতে পারেন। নিজেদের মধ্যে শিক্ষার সমস্যা, সমাধান ও ভবিষ্যৎ করণীয় ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করতে পারেন। একটি সময় দেখবেন আপনি চমৎকার কথা বলার আর্ট আয়ত্ত করে ফেলেছেন, সাহসী হয়েছেন, যেকোনোসংখ্যক দর্শকের সামনে অনায়াসে কথা বলতে পারছেন। আপনি আরো শিখে গেছেন গুছিয়ে কথা বলা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট বিষয় আলোচনা করা। পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেমিনারে যোগদান করা সহজ হবে। এভাবে শিক্ষকরা যেখানে যতটুকু সুযোগ পান, সেটুকু যদি কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে তাঁদের পেশাগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023341178894043