শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তবুও তিনি উপাচার্য

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

দলীয় প্রভাব খাটিয়ে শর্ত পূরণ না করেই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিলেন ড. মো. আব্দুল বাসেত। পরবর্তীতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে হয়েছেন হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যও। আর উপাচার্য হয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট চালাচ্ছেন। প্রফেসর ড. মো. আব্দুল বাসেত ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর ছিলেন প্রকল্পের আওতায় সিলেট সরকারি ভেটেইরিনারি কলেজের সহকারী প্রফেসর। সেখান থেকে শর্ত পূরণ না করে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে হয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) প্রফেসর।রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওয়েছ খছরু। 

প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয়টিতে দ্বিতীয় বিভাগধারী বাকৃবি’র সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ভিসি হয়ে নিজের ইচ্ছেমতো চালাচ্ছেন হবিগঞ্জবাসীর স্বপ্নের এ প্রতিষ্ঠানকে। সিকৃবি আইন-২০০৬ এর ধারা ৫৯ উপধারা ২ (ছ) অনুযায়ী বিলুপ্ত ভেটেইরিনারি কলেজ থেকে আত্তীকৃত কোনো শিক্ষকের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পরীক্ষার কোনো একটিতে প্রথম শ্রেণি না থাকলে শিক্ষক পদে আত্তীকরণের যোগ্য হবে না। তবে ২০০৬ সালের ২রা নভেম্বর পরবর্তী অনধিক ৫ বছরের মধ্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা বা এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে নিয়োজিত থাকতে পারবে। 

এরূপ শর্ত থাকলেও আবদুল বাসেত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে না পারলেও দলীয় প্রভাবে শিক্ষক হিসেবে টিকে থাকার পাশাপাশি পেয়ে যান অতিরিক্ত দায়িত্বও। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে  লিয়েন ছুটি নিয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের প্রফেসর হিসেবে যোগদানের পর আর্থিক অনিয়মে জড়ান বাসেত। পবিপ্রবিতে কর্মরত থাকাকালীন অগ্রীম উত্তোলিত ১লাখ ৯৭ হাজার টাকা সমন্বয় না করে ২০১৩ সালে দলীয় প্রভাবে পবিপ্রবি থেকে চূড়ান্ত অব্যাহতিপত্র না নিয়ে ফের সিকৃবিতে এসে যোগদান করেন। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের   দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেই সময়ে বিভিন্ন বিভাগে ৫৫ জন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানে নিজের পছন্দের লোক নিয়োগ দিতে চান আব্দুল বাসেত। কিন্তু এই অবৈধ দাবি না মানায় ওই সময় রেজিস্ট্রারকে মারধর করেছিলেন তিনি। এ ঘটনায় আন্দোলনের মুখে প্রক্টর বাসেত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি ও প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের আশীর্বাদে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের  মার্চ মাসে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. আব্দুল বাসেত। ভিসি নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসে অবস্থান করার কথা থাকলেও ড. বাসেত অফিস করেন সিলেট ও ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরাম একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট ও অর্থ কমিটির সভাও হয় ঢাকায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভিসি ও তার সহযোগীদের দুর্নীতির সুবিধার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ  নীতিনির্ধারণী  ফোরাম সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলে হবিগঞ্জ তথা সিলেট বিভাগের কোনো শিক্ষাবিদকে রাখা হয়নি। ভিসি হিসেবে যোগ দেয়ার পর থেকেই স্থানীয় এক প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্যসহ মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তাকে নিয়ে ভিসি গড়ে তোলেন নিয়োগ বাণিজ্য সিন্ডিকেট। পাশাপাশি শুরু করেন আর্থিক অনিয়ম। এই সিন্ডিকেট একদিকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছে পাশাপাশি নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। হবিগঞ্জ শহরতলীর ভাদৈ এলাকায় ছোট একটি ভাড়া ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস চালু করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। ছোট এই ভবনে নেই পড়াশোনার পরিবেশ।   

 হবিগঞ্জে ক্যাম্পাসের জন্য ভবন ভাড়া করা হলেও ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন করে সরকারি অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। ভিসির শ্যালকপুত্র খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশনের কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন অভির মধ্যস্থতায় এখানে চলে নিয়োগ বাণিজ্য। ভিসি হবিগঞ্জ জেলা শহরে বাড়ি ভাড়া নেয়ায় বেসিকের ৪০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া প্রাপ্য হলেও ক্ষমতা ও অনিয়মের মাধ্যমে বিভাগীয় শহরের ন্যায় বেসিকের ৪৫ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া নেয়ায় ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ভাড়া বাবদ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন। প্রফেসর ড. বাসেত হকৃবিতে যোগদানের পর নিজের গাড়ি ব্যবহার বাবদ মাসে ইউজিসি’র অনুমোদিত ৭৪ হাজার টাকার বিপরীতে প্রতিমাসে ২ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ভিসির যাতায়াতের জন্য ইউজিসি’র বরাদ্দ দেয়া ৯৪ লাখ টাকা দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি থেকে গাড়ি কেনার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ভিসি বাসেত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক অনিয়ম করে ১ কোটি টাকার বেশি মূল্যে গাড়ি ক্রয় করেছেন। যা পরবর্তীতে ইউজিসি ও সরকারি অডিটে আপত্তি জানানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভিসি হিসেবে আব্দুল বাসেত যোগদানের পর প্রথমে এডহক ভিত্তিতে কিছু পদে জনবল নিয়োগ দেন যাদের অধিকাংশই তার নিজ এলাকার। পরবর্তীতে কয়েকটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৬০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে ৮০ জনের নিয়োগ নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। 

নিয়োগ পরীক্ষা হবিগঞ্জে না হয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। কোনো প্রবেশপত্র না দিয়ে পরীক্ষার একদিন আগে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। এতে পরীক্ষায় প্রবেশের আগমুহূর্তে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়। ২৯শে জানুয়ারি ঢাকায় এসব পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১৯শে মার্চ দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার ফার্মগেটের কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে হকৃবির চতুর্থ সিন্ডিকেট সভা শেষে নিয়োগপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন  ভিসি প্রফেসর মো. আব্দুল বাসেত। এই ঘোষণার পরদিনেই নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানও সম্পন্ন করেন। ওই নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ৮০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব পদে শত-শত চাকরি প্রত্যাশী আবেদন করলেও পরীক্ষার সুযোগ না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুরু থেকেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন ভিসি। তারা বলেন, দুর্নীতিবাজ ভিসির অধীনে কখনো হকৃবির শিক্ষার মানের উন্নতি হবে না। হবিগঞ্জের সকল শিক্ষার্থী ও সচেতন লোকজন তাকে পদত্যাগের কথা বললেও তিনি কর্ণপাত করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল আব্দুল বাসেতের প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে না যেতে ভয়-ভীতি দেখিয়েছিলেন তিনি।

এ ব্যাপারে ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল বাসেত জানিয়েছেন, আমাকে প্রফেসর কীভাবে করা হলো সেটি জানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫ জন শিক্ষকসহ যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেখানে কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়নি। হবিগঞ্জে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ না থাকায় সেটি ঢাকায় বসেই নেয়া হয়েছে। একইভাবে সুবিধা না থাকায় একাডেমিক বা সিন্ডিকেট সভা ঢাকায় করা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023810863494873