শিক্ষক হতে দেয়া ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় পেটালেন গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের থেকে ৯৪ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ আছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি জাকির হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি দেয়া বা টাকা ফেরত দেয়া-কোনোটিই করেননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ঘুষ দেয়া চাকরিপ্রার্থীরা। সেই তাদের এবার বাসায় ডেকে নিজের হাতে রড দিয়ে পেটালেন প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর মিন্টো রোডের ৩৫ নম্বর সরকারি বাসায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন মার খেয়ে পালিয়ে আসা এক ভুক্তভোগী।

জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সুপারিশ করতে যান ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ’ এর আবু সুফিয়ান বিশ্বাসসহ কয়েকজন। আবু সুফিয়ান সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব ও খুলনা জেলার সভাপতি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন মাসে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বাসায় ওই মিটিং হয়।

আবু সুফিয়ানের দাবি, ওই সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ৪৮ জনকে নিয়োগের জন্য ৬ কোটি টাকায় রফা হয়। মন্ত্রীর ভাইয়ের ছেলে লিটন ও ড্রাইভার মোমিনকে টাকা বুঝিয়ে দিতে বলেন। তখন অগ্রিম হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী কল্লোলের উপস্থিতিতে লিটন ও মোমিনের কাছে ৪৮ জন চাকরি প্রার্থীর জন্য ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বুঝিয়ে দেন আবু সুফিয়ান ও নাছির হাওলাদার নামের এক চাকরি প্রার্থী। তবে ওই ৪৮ জনের কেউই চাকরি পাননি।

ঘুষ দেয়া প্রার্থী অভিযোগ, অগ্রীম টাকা দেয়ার পরও চাকরি না হওয়ায় ১১ জুন প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে দেখা করেন আবু সুফিয়ানসহ অন্যান্যরা। এ সময় মন্ত্রী তাদের টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত পেয়ে গত ১৪ মে ৪৮ জনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন আবু সুফিয়ান। এতে ক্ষুব্ধ হন প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

সম্প্রতি ঘোষিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি জাকির হোসেন। এতে ক্ষুব্ধ হন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের ওপর। বৃহস্পতিবার তাদের টাকা ফেরত নেয়ার কথা বলে মন্ত্রীর বাসায় ডাকেন ব্যক্তিগত সহকারী কল্লোল। কল্লোলের কথা মতো সকাল ১১টায় প্রতিমন্ত্রীর মিন্টো রোডেরে ১১ নম্বর বাসায় যান আবু সুফিয়ান, নাছির হাওলাদার ও জাহিদ হাসান নামের তিনজন।

ওই তিনজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী কল্লোলের রুমে ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওপর থেকে ওই রুমে চলে আসেন প্রতিমন্ত্রী। এ সময় প্রতিমন্ত্রী তার কর্মকর্তা, কর্মচারী ও বাসার নিরাপত্তায় থাকা ৭ থেকে ৮ জন ওই রুমে প্রবেশ করে। এ সময় রুমের দরজা আটকে দিয়ে তিনজনকে পেটাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে প্রতিমন্ত্রী নিজেও রড দিয়ে পেটাতে থাকেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ছোটাছুটি করে রুমের দরজা খুলে ফেলেন ঘুষ দেয়া প্রার্থীরা। তিনজন থেকে নাছির হাওলাদার ও জাহিদ হাসান প্রধান ফটক দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। আবু সুফিয়ান পাশের দেয়াল টপকে ডিবি কার্যালয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েন। পরে ডিবি কার্যালয়ের নিরাপত্তায় থাকা সদস্যরা তাকে আটক করে বলে জানিয়েছেন জাহিদ হাসান। এ সংবাদ লেখার কিছুক্ষণ আগে বেলা ২টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে যান প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী কল্লোল।

মন্ত্রীর বাসা থেকে বের হয়ে আসার পর জাহিদ হাসান ও নাসির হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ও তার ব্যক্তিগত সহকারী কল্লোলের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও দুজনের কেউ ফোন রিসিভ করেননি। পরে দুজনেরই মোবাইল নাম্বারে ও হটস্যাপে মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে আবু সুফিয়ান এখন কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছেন তা ডিবি কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে রাত সাড়ে দশটায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৮ ডিসেম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রথম পর্বের পরীক্ষা হওয়ায়, ভিড় ও তদবির এড়াতে প্রতিমন্ত্রীর মিন্টো রোডস্থ বাসায় অপরিচিত কাউকে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধ করা হয়। বৃহস্পতিবার কতিপয় ব্যক্তি প্রতিমন্ত্রীর মিন্টোরোডস্থ সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করতে চাইলে হাউসগার্ড বাধা দেয়। কিন্তু তারা বাধা অগ্রাহ্য করে বাসার ভেতর  প্রবেশ করে এবং গার্ডদের সাথে চিৎকার, চেঁচামেচি ও ধস্তাধস্তি  করতে থাকে। শোরোগোল শুনে বাসার লোকজন  জানতে আসলে তাদের সঙ্গেও আগন্তুকরা দুর্ব্যবহার শুরু করে। একপর্যায়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একজন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, প্রতিমন্ত্রী দ্ব্যার্থহীনভাবে জানান, তাঁর সময়ে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকসহ নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ ফলাফল প্রকাশ করেছে  বাংলাদেশ  প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (বুয়েট) এখানে অন্যকোন কিছু করার প্রশ্নই আসে না। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে, যা স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। কেউ এ নিয়োগ নিয়ে কোনো ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেনি। আসন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হবে বলে প্রতিমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করতে চান।

গত ২৪ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগের কথা বলে শত শত কোটি টাকা ঘুষ বাবদ হাতিয়ে নেয়া ও মাদক সেবনের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। ফের কুড়িগ্রাম-৪ আসনের (চিলমারী,রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলা) সংসদ সদস্য হতে মনোনয়ন প্রত্যাশী জাকির হোসেন প্রচারণা শুরু করে দিলেও গত ২৬ নভেম্বর প্রার্থী ঘোষণার পর দেখা যায় তিনি মনোনয়ন পাননি। 

এদিকে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ থাকলেও গতকাল বুধবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, টাকা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। অধিদপ্তর বলছে, প্রার্থীর মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই শিক্ষক পদে চাকরি হবে। কেউ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখালে তাকে থানায় সোপর্দ করা বা থানা বা গোয়েন্দা সংস্থাকে জানাতে প্রার্থীদের অনুরোধ করেছে অধিদপ্তর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস - dainik shiksha সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড - dainik shiksha এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন - dainik shiksha এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি উত্তপ্ত - dainik shiksha ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি উত্তপ্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাত ভাঙলেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাত ভাঙলেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক সাংবাদিক নিপীড়নের আইনগুলো এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব - dainik shiksha সাংবাদিক নিপীড়নের আইনগুলো এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দিতে আবেদন আহ্বান - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দিতে আবেদন আহ্বান শিরীন শারমিনের পদত্যাগে স্পিকার পদে কি শূন্যতা তৈরি হলো - dainik shiksha শিরীন শারমিনের পদত্যাগে স্পিকার পদে কি শূন্যতা তৈরি হলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053479671478271