শিক্ষাই হোক মেগা প্রকল্প

মো. রহমত উল্লাহ্ |

'বাইচান্স শিক্ষক নয়, আমাদের দরকার মনে-প্রাণে শিক্ষক। তাদের মাধ্যমেই আমরা দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে চাই। এজন্য শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার। শিক্ষাই হবে মেগা প্রকল্প। তাই আমাদের শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সময়ের প্রয়োজনেই তাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে রাখতে হবে।' 

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ৩০ জুলাই প্রথম 'বাংলাদেশ স্টার্টআপ' সম্মেলনে এমন আরো অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন। যদি ভুল না বুঝে থাকি তাহলে 'বাইচান্স শিক্ষক, মানে ঘটনাচক্রে শিক্ষক, দৈবক্রমে শিক্ষক, ভাগ্যক্রমে শিক্ষক, হঠাৎ করে শিক্ষক। অর্থাৎ যিনি শিক্ষক হতে চান না তিনি অন্য কিছু হতে ব্যর্থ হয়ে কোনো না কোনো উপায়ে শেষমেষ শিক্ষক। কথাটি বলতে ও শুনতে খুবই খারাপ লাগছে! যদিও সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তবে যাদের জন্য প্রযোজ্য দায়টা কি তাদের? বাস্তব অবস্থাটি এমন হলো কেনো, হচ্ছে কেনো, হবে কেনো?

'মনে-প্রাণে শিক্ষক' মানে চিন্তায়-চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে, মননে শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে শিক্ষক হবার ইচ্ছায় শিক্ষক। নিজের ও মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে শিক্ষক। শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে শিক্ষক। শিক্ষক হবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষক। শুধু শিক্ষকতার জন্য শিক্ষক। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত এমন শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না! বেসরকারি তো দূরের কথা, সরকারি চাকরিতেও পছন্দক্রমের তলানিতে থাকে শিক্ষকতা! সরকারি শিক্ষক হয়েও অনেকেই চলে যেতে চান, চলে যান অন্য পেশায়, অন্য ক্যাডারে। 

কিন্তু, আমিও আমার সন্তানের জন্য 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' চাই না, 'বাইচান্স শিক্ষক' চাই না। 'মনে-প্রাণে শিক্ষক' চাই, সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চাই। আমি নিজেকে অযোগ্য শিক্ষক মনে করি না। তথাপি আমি আমার চেয়ে অধিক যোগ্য শিক্ষক চাই। এ চাওয়া আজকের নয়। যখন শিক্ষার মূল ভিত্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসএসসি পাস শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তখনও আমি আপত্তি করেছি, লিখেছি। যখন ব্যাপকহারে কোটা সংরক্ষণ করে তুলনামূলক বেশি যোগ্য ছেলেদের বাদ দিয়ে কম যোগ্য মেয়েদের শিক্ষকতায় প্রবেশ করানো হয়েছে তখনও আমি আপত্তি করেছি, লিখেছি। যখন বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে যোগ্যতা কমিয়ে একাধিক তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারী প্রার্থীকে শিক্ষকতায় প্রবেশ করানো হয়েছে তখনও আমি আপত্তি লিখেছি। এখনো বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে যোগ্যতা কমিয়ে একটি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারীকে শিক্ষক হবার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে আমি তীব্র আপত্তি করছি। সরকারি শিক্ষক হবার জন্য যদি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারীকে গ্রহণ করা না হয় তাহলে বেসরকারি শিক্ষক হবার ক্ষেত্রে কেনো গ্রহণ করা হবে? বেসরকারি শিক্ষকরা তো এ দেশের শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি সন্তানের লেখাপড়া করাচ্ছেন।  

আমার মতো আরও অনেকেই 'বাইচান্স শিক্ষক' চান না, 'মনে-প্রাণে শিক্ষক' চান। অর্থাৎ সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যারা সন্তানকে ভালোবেসে ভালো ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসায় ভর্তি করাতে চান তারা সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যারা শিক্ষক হয়েও সন্তানকে নিজের প্রতিষ্ঠানে না পড়িয়ে আরো ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান তারাও অধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যারা সন্তানকে ভালোভাবে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, তেলাওয়াত, খেলা, সাঁতার, শিকার, ড্রাইভিং, পাইলটিং ইত্যাদি শেখাতে চান তারাও সে লাইনের সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যারা সকল শিক্ষার্থীর অধিক কল্যাণ চান, আরো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চান, প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিক যোগ্য কর্মী চান, দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন চান, তারা সবাই সর্বাধিক যোগ্য শিক্ষক চান। অর্থাৎ সকল বিবেকবান মানুষ তার সন্তানকে দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বাধিক দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক শিক্ষক চান। শিক্ষকের নিকট থেকে আরও বেশি জ্ঞান চান, দক্ষতা চান, ত্যাগ চান। 

এমতাবস্থায় 'বাইচান্স শিক্ষক নয়, আমাদের দরকার মনে-প্রাণে শিক্ষক' এই বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় যদি এমন বুঝিয়ে থাকেন যে, নতুন যারা শিক্ষকতায় আসবেন তারা যেনো 'বাইচান্স শিক্ষক' না হয়ে 'মনে-প্রাণে শিক্ষক' হন, যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সর্বাধিক সফল শিক্ষক হন। তাহলে নিশ্চয়ই শিক্ষক পদের জন্য এখনই নির্ধারণ করতে হবে সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা; যাতে সর্বোচ্চ মেধাবীদের পেশা পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকে শিক্ষকতা। সেইসাথে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সকল স্তরের সকল শিক্ষকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকতার তথা পাঠদানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও কলা-কৌশল সম্পর্কিত মূল প্রশিক্ষণ। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিক্ষক হবার জন্য ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। কেননা যতোই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, নতুন শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোক, উন্নত সুযোগসুবিধা সম্বলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক; শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা অসম্ভব।

শিক্ষক পদের জন্য সর্বাধিক যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণে বিলম্ব করা মানেই দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করা। কেননা, এখন যিনি শিক্ষক তথা মানুষ গড়ার কারিগর হবেন তিনি তুলনামূলক কম যোগ্য হলে কমপক্ষে ৩০ বছর তৈরি করবেন অগণিত অযোগ্য বা কম যোগ্য মানুষ। অর্থাৎ অযোগ্যতা ছড়িয়ে দেবেন সকল ক্ষেত্রে, সকল পেশায়! 

অপরদিকে এখন যিনি শিক্ষক তথা মানুষ গড়ার কারিগর হবেন তিনি সর্বাধিক যোগ্য হলে কমপক্ষে ৩০ বছর তৈরি করবেন অগণিত অধিক যোগ্য মানুষ। দ্রুত বাস্তবায়িত হবে প্রকৃত স্মার্ট বাংলাদেশ। 

মনে রাখতে হবে, তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক দিয়ে অধিক যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, আমলা, কৃষিবিদ, কর্মী তথা সকল পেশাজীবী ও জনপ্রতিনিধি তৈরির প্রত্যাশা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবাস্তব, অসম্ভব। আশা করি বিষয়টি এখনই অনুধাবন করবে বর্তমান সরকার, দ্রুত বাস্তবায়ন করবে শিক্ষামন্ত্রীর সেই মূল্যবান বক্তব্য- 'শিক্ষাই হবে মেগা প্রকল্প। শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।' 
 

লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই - dainik shiksha অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002485990524292