শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ড. মাহবুব

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

ড. মাহবুবুর রহমান। রাজধানী ডেমরার সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। একই সঙ্গে নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের চেয়ারম্যানও তিনি। এই দুই প্রতিষ্ঠান দিয়ে শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে এখন কোটিপতি এক সময়ের অতিদরিদ্র এই কলেজ শিক্ষক। ভর্তি বাণিজ্য, বাধ্যতামূলক কোচিং, অতিরিক্ত ফি—এভাবে তিনি নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তার ডজনখানেক বাড়ি-ফ্ল্যাট, শপিং কমপ্লেক্স, দুই মেয়ের নামে আলাদা বাড়ি, শ্বশুরের নামে জমি, কলেজের পাশেই বিলাসবহুল বাংলো বাড়ি—অনুসন্ধানে তার এসব সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১৭ বছরে আওয়ামী লীগের সব মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয় থাকলেও ৫ আগস্টের পর নিজেকে পরিচয় দেন বিএনপিপন্থি শিক্ষক হিসেবে। বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) দৈনিক কালবেলা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আকরাম হোসেন। 

প্রতিবেদনে আরো জানা যায়,  শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তিতে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা নেওয়া হয়। স্কুল ও কলেজ শাখা মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের সবার কোচিং বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া অতিরিক্ত বেতনসহ নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমের নামে টাকা আদায় করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ভর্তি বাণিজ্য ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধসহ বেশ কিছু দাবি নিয়ে গত ২০ আগস্ট শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। তাদের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অধ্যক্ষসহ যেসব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেছেন বা নানা

ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছেন, তাদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে; যেসব শিক্ষকের নামে বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারির অভিযোগ আছে, তাদের অনতিবিলম্বে বহিষ্কার করতে হবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব (অডিট রিপোর্ট) ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে; জোরপূর্বক সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আহ্বান করা যাবে না এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দকৃত অতিরিক্ত নম্বর প্রদানের নিয়মটি বাতিল করতে হবে; স্কুল ও কলেজে ইবাদতখানা, পাঠাগার ও ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ রাখতে হবে এবং সেখানে নিয়মিত ক্লাস করানো নিশ্চিত করতে হবে; অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা আবেদন করলে বিনা বেতনে অধ্যয়ন অথবা বেতন কমানো নিশ্চিত করতে হবে।

আরো পড়ুন: 

অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

যে কলেজ কেরাণির হিসাবে অবৈধ ২৪ কোটি টাকা

মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অবৈধ ২৪ কোটি টাকা, দুদকের মামলা

সামসুল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনিয়মের কিছু নথি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। গত ১৬ জুলাই একাদশ শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী ভর্তির কাগজে দেখা যায়, আলাদা দুটি রসিদে তার কাছ থেকে দুই দফায় টাকা নেওয়া হয়েছে মোট ১৩ হাজার। এমপিওভুক্ত একটি কলেজে যা হতে পারে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা।

প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৮ হাজার শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কোচিং করতে হতো। তার জন্য নেওয়া হতো আলাদা ফি। বাড়তি ফি নেওয়ার অভিযোগে ২০২৩ সালে সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। একই সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠদান কেন বাতিল করা হবে না, তারও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু নোটিশের কোনো ধরনের তোয়াক্কা না করে ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের চেয়েও দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ১৩ হাজার এবং বিজ্ঞান বিভাগে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ভর্তি ফি আদায় করছে। তাছাড়া সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হতে চাইলে লটারির মাধ্যমে সিট বুকিং হয়ে থাকে। সেখানেও প্রতি সিটে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

এই অনিয়ম চলছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। এভাবে শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে অঢেল সম্পদ গড়েছেন তিনি। নিজের নামে গড়ে তুলেছেন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। রাজধানীর মাতুয়াইলের ৬৩নং ওয়ার্ডের মৃধা বাড়ি রোডে বিলাসবহুল চারতলা বাড়ি রয়েছে তার। সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ রোডে স্মার্ট শপিং কমপ্লেক্স, কমপ্লেক্সের পাশেই কফি হাউস বিল্ডিংয়ের ৬ তলায় একাধিক ফ্ল্যাট, রহমতপুর বন্ধন টাওয়ারে একটি ফ্ল্যাট, ছোট মেয়ের নামে আলামিন রোডে ছয়তলা বাড়ি, শ্বশুরের নামে দামড়িপাড়া মৌজায় ১১১ শতক জমি কিনেছেন। স্থানীয়দের বক্তব্য, এই জমি ড. মাহবুবুর রহমান তার শ্বশুরের নামে ক্রয় করেছেন। এখানে প্রাইভেট হাসপাতাল করবেন। এই জমির বর্তমান দাম প্রায় ৫০ কোটি টাকা। যদিও দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা। তাছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বিলাসবহুল বাংলো বাড়ি করেছেন মাহবুবুর রহমান। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের নিয়ে প্রমোদ করতেন এই বাড়িতে, যার কিছু ছবিও এসেছে  প্রতিবেদকের হাতে। চড়েন কোটি টাকার ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়িতে।

জানা যায়, ড. মাহবুবুর রহমানের বাবা ছিলেন পোস্ট অফিসের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা মাহবুবুর রহমান ১৯৯২ সালে সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তারপর থেকেই শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সখ্য থাকায় কেউ তার অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি।

স্থানীয়রা জানান, মাহবুবুর রহমান চলাফেরা করেন মাফিয়ার মতো। তার বাংলোতে আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রশাসনের লোকজনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বিগত সময়ে একজন শিক্ষার্থী বা অভিভাবকও যদি তার প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে বলার চেষ্টা করত, তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হতো। গত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ৫ আগস্টের পর নিজেকে বিএনপিপন্থি শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।

এসব নিয়ে ড. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে সম্প্রতি সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এই প্রতিবেদককে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একটু পর গেটকিপার এসে বলেন, ‘স্যার মিটিংয়ে আছেন। পরে আসতে বলেছেন।’ এর পরদিন গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। মেসেজ দিয়েও মেলেনি উত্তর।

প্রতিষ্ঠানটির ভর্তি বাণিজ্য ও কোচিং বাণিজ্যের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অতিরিক্ত ফি আদায় এবং কোচিং বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত ফি শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন লিখিত জবাব দিয়েছিল তারা। তবে এ ধরনের কার্যক্রম এখনো চলমান থাকলে, আর কেউ অভিযোগ দিলে বোর্ড অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

একজন কলেজ শিক্ষকের শিক্ষা বাণিজ্য নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। তিনি (ডা. মাহবুবুর রহমান) শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে বহুমাত্রিক অপরাধ করেছেন। প্রথমত, ক্ষমতার অপব্যবহার ঘুষ বাণিজ্য এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা। দ্বিতীয়ত, এমপিওভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া তিনি কীভাবে এত অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051271915435791