‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’।
রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ও নির্দেশিত বর্তমান কারিকুলাম (১ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি) পর্যন্ত দেখে সবার মতো আমিও অভিভূত ও আন্দোলিত। শ্রেণি অনুযায়ী সব যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। শ্রেণি পাঠের সব ক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করলে শিক্ষার্থী যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা, বাস্তব শিক্ষা, উপস্থাপন শিক্ষা, নেতৃত্বের শিক্ষা ও সুনাগরিকের শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধশালী করতে পারবে। ভবিষ্যতে নিজেকে যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সারা দেশে (এনসিটিবি)-র কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এবছর (২০২৩) প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে। আগামী বছর (২০২৪) এ দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ শ্রেণিতে এবং পর্যায়ক্রমে এটি ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলতে থাকবে।
বর্তমান শিক্ষাক্রম-২৩ নিয়ে কম আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে না । অভিভাবক সমাজ রাজপথ প্রকম্পিত করছে। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে। অনেকে এ কারিকুলাম কে স্লো পয়জন বলছেন।
পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে চলতে হলে নিজেকে সময়ের সাথে প্রস্তুত করতে হবে। একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করাই হবে তার কর্ম। আর নিজেকে প্রস্তুত করতে হলে জানতে হবে, পড়তে হবে, শিখতে হবে, তা যেখানেই হোক। এখনো আমাদের ছেলে মেয়েরা বাংলা, ইংরেজি পড়তে পারেনা, তাহলে এদের কি হবে। এমসিকিউ আসলো, সৃজনশীল আসলো চলে গেলো, জিপিএ ৫ আকাশ ছোঁয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি ইংরেজিতে বলতে গেলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, গলা বুক শুকিয়ে যায়। তাহলে আমাদের কি জিপিএ ৫ পেলে হবে, অন্য কিছু নয়? তাহলে ত্রিভুজ কি দোষ করলো?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, অভিভাবক কান্না করছেন। সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে বাবা মায়ের উদ্বিগ্নতা থাকবে। আগেও ছিলো বর্তমানেও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে । কিন্তু কষ্ট লাগে যখন কিন্ডারগার্টেনে পড়া কোমলমতি শিশুটি বইয়ের ব্যাগের ভারে বাঁকা হয়ে যায়। এ ব্যাথা কেউ বোঝে?
দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এতো বড় পরিবর্তন এর আগে হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। জীবনের সবক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন আসে তাহলে ক্ষতি কি? পরিবর্তন তো সময়ের প্রয়োজনে হয়। অনেক অভিভাবক এই পরিবর্তন কে সহজে মেনে নিতে পারছেন না। শুধু অভিভাবক কেনো, খোদ শিক্ষকরাও মেনে নিতে পারছেন না। জানি মনে নেয়া আর মেনে নেয়া অনেক কঠিন। তবে সত্যি কথা যতদিন না আমাদের শিক্ষকরা মনে না নিবেন ততদিন বিভ্রান্তি চলতে থাকবে।
তবে রাষ্ট্রীয়শিক্ষা নীতি নির্ধারকদেরকে ও অভিভাবক, শিক্ষকসহ অনান্যদের মতামত কে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আলোচনার দুয়ার উম্মুক্ত করে দিতে হবে। তবে আমি সবাই কে বিনীত অনুরোধ করবো পরিবর্তিত কারিকুলামটা বোঝার জন্য। মুল্যায়নের পরিমাপক যদি সংখ্যায় প্রকাশ না করে সাংকেতিক চিহ্ন বা প্রতিক দিয়ে প্রকাশ করা হয়, ফলাফল তো একই।
বাংলা (অষ্টম শ্রেণি) দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ প্রমিত বলি প্রমিত লিখি, তৃতীয় অধ্যায়ঃ লেখা পড়ি লেখা বুঝি, চতুর্থ অধ্যায়ঃ শব্দ বুঝি, শব্দ লিখি । ইংরেজি (অষ্টম শ্রেনি) Beauty in Poetry, The Bizhu Festival, Language and power, আগেও শ্রেণি ভিত্তিক ভাষা, ব্যাকরণ, গল্প, কবিতা ছিলো, এখনও আছে, শুধু প্রয়োগটা আলাদা, যোগ্যতা অর্জনের নিয়ামক ধারনা আলাদা। শিক্ষার্থী বিভিন্ন জায়গা থেকে শিখবে, শিক্ষক শুধু প্রদর্শক হিসেবে তাকে সহায়তা করবে। তবে এখানে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষক মুল্যায়নে যেন, আমার কাছে পড়ো না, ত্রিভুজ তুমি পাবে না, এ নীতি যেনো প্রয়োগ না করে । দ্বীতিয়ত শ্রেণি পাঠ সংশ্লিষ্ট উপকরণের সদ্বব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থী কে নিজেকে প্রকাশ করার পরিবেশ করতে হবে। সব শিশুর মধ্যে প্রতিভা আছে, সে প্রতিভা বিকষিত করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা পালন করতে হবে অভিভাবকদের। অভিভাবককে সম্মান করতে হবে। স্কুলে প্রতি মাসে অভিভাবক সভা করতে হবে সন্তানের ভালো মন্দ তার সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।
একটা বাস্তব উদাহরণ পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করছি। একজন অভিভাবকের দুটি ছেলে। ছেলে দুটি অত্যন্ত মেধাবী। বাবা মা কম লেখা পড়া জানা হলেও ছেলে দুটির লেখাপড়ার দিকে তাদের অন্তরিকতার কোন কমতি নেই। সব শ্রেণিতে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে চলেছে। এলাকার সবাই প্রত্যাশা করে তারা ভবিষ্যতে ভালো কিছু করবে। সবার মুখে ছেলেদের ভালো শুনলেও সব সময় পড়া যাচাই করা সম্ভব হয়না। কিন্তু ছেলে দুটির বাবা পরীক্ষার সময় একটা কাজ করতেন। ছেলেরা যখন পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসতো এক এক করে কাছে ডেকে নিতো, পরীক্ষার কথা জানতে চাওয়ার পরে বলতো, এক নং প্রশ্নের উত্তর কি বল তো। এভাবে সব প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করতেন। যে প্রশ্নের উত্তর বলতে বেধে যেত, তখন বলতেন তোমার তো এ প্রশ্নের উত্তর ভালো হয়নি।
এ হচ্ছে আমাদের বাবা মা আমাদের প্রাণের অভিভাবক। তাদের কে হেয় করা যাবে না, ছোট ভাবা যাবে না, অসম্মান করা যাবেনা। যথাযথ সম্মানের সঙ্গে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। সুসন্তান যেমন অভিভাবক গুণে হয়, তেমনি কুসন্তানও অভিভাবকের অবহেলার জন্য হয়।
লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।