শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষকতা—এই শব্দগুলোর মধ্যবর্তী সম্পর্ক দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কেউ বলেন শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এর জন্য দায়ী। কেউ বলেন শিক্ষকদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণে তাদের মধ্যে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। কারণ যাই-ই হোক না কেন, শিক্ষা ও শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্ক যে কমেছে, তা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষকের শিক্ষাদানের ক্ষেত্র ও পরিবেশ বর্ণনা করলে এ বিষয়টি পরিষ্কার হবে। শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, উৎকর্ষ শিক্ষাদানের জন্য গবেষণা শিক্ষার প্রয়োজন থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের গবেষণা করার সুযোগ আমাদের দেশে কতটুকু রয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দের গবেষণার সুযোগ থাকায় তারাই এই সুযোগ পেয়ে থাকেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো কোনো পদে কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন এমন শিক্ষক নিয়োগ করা হলেও তারা শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের অর্জিত গবেষণালব্ধ জ্ঞান তুলে ধরার সুযোগ পান কি? বিশ্বব্যাপী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলেও তাদের শিক্ষণব্যবস্থায় গবেষক শিক্ষকদের সান্নিধ্য পাওয়ার পৃথিবীর অনেক দেশে থাকলেও আমাদের দেশে সেই সুযোগ নেই। মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে, পাঠ নির্বাচনে, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষা গবেষকদের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকলেও মাধ্যমিক শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা সেখানে একেবারেই নগণ্য। পাঠ নির্বাচনে এবং শিক্ষণ কার্যক্রম গতিশীল করার প্রক্রিয়া তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ মাঠপর্যায়ের শিক্ষার পরিবেশ, অবকাঠামো যাচাই-বাছাই করার সুযোগ কতটুকু পেয়ে থাকেন? অথচ তাদের তৈরি করা শিক্ষা পদ্ধতি ও পাঠক্রম অনুসারে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা দান করা হয়। এতে করে পরিকল্পনা অনুসারে দেশব্যাপী সরকারের শিক্ষা কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিতভাবে গতিশীল হয়েছে কি? বর্তমানে বাংলাদেশে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা যেন তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নোটবই, গাইডবই থেকে মুখস্থবিদ্যার নির্ভরতা কাটানোর জন্য মূল বইয়ের পাঠের ওপর জোর দেওয়ার জন্য সৃজনশীল ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হলেও এ ব্যবস্থা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কতটা বিপর্যয়ে ফেলেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় শহর ও গ্রামের মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের দিকে তাকালে। আগের পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নোট-গাইড ব্যবহার করত; বর্তমান পদ্ধতিতে নোট-গাইডটি ব্যবহারের কাজটি শিক্ষকেরা করেন।
এখনো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ যথার্থ সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। পরীক্ষার প্রশ্নের জন্য তারা এখনো বাইরের ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীল প্রশ্ন করার কাজটি রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। যদি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের উচ্চতর গবেষণার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার মাঠপর্যায়ের তথ্য সঠিকভাবে সংগ্রহ করতে সক্ষম হতো। এতে মাধ্যমিক শিক্ষার মান আরও উন্নত করার সুযোগ তৈরি হবে। তাই সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য গবেষণামূলক উচ্চশিক্ষার সুযোগ করা হলে তার সুফল এই স্তরের শিক্ষার্থীরা পেত।
ড. সনজিত পাল : শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ।