শিক্ষাদান কৌশলে শিক্ষকের নেতৃত্ব চেতনা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে দীর্ঘ লকডাউন থাকায় কাঠামোবদ্ধ শ্রেণী শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সংযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন। ফলে শিক্ষার ক্ষতি অনিবার্য কারণেই প্রতিফলিত বিধায় শিক্ষার্থীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতি, মন-মানসিকতা ও শারীরিক দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে চরম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং শিক্ষার এ ক্রান্তিকালে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, অভিভাবক এবং সাধারণ জনগণকে যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় শিক্ষকদের সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে।

অতিমারীর প্রভাবে যখন থেকে শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা, তখন থেকেই শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে এবং তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ফেসবুকে লাইভ ক্লাস নেয়া, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করা, কখনও গুগলে বা কখনও জুমের মাধ্যমে ক্লাস নেয়া এবং যাদের কাছে ইন্টারনেট নেই তাদের ফোন করা বা টেক্সট করা ইত্যাদি নানা উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া ছিল শিক্ষক নেতৃত্বের বিশেষ কয়েকটি সফলতার দিক। কিন্ত যারা প্রবীণ শিক্ষক, যাদের অনেকেই চাকরির মেয়াদ শেষ করে অবসরে যাওয়ার উপক্রম, প্যান্ডামিকের প্রভাব কাটিয়ে টিকে থাকা ছিল তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণের সঙ্গে পরিচিত না থাকায় অনেকে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছেন, আবার ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে শিক্ষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছেন। অতিমারির এ সময়ে শিক্ষা সেক্টরে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য স্বতন্ত্রভাবে শিক্ষকদের শক্তিশালী করা একান্ত প্রয়োজন।

করোনাকালে নিউ নরমাল শিক্ষার উন্নয়নে দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে কাজ করেছেন বা যারা আধুনিক শিক্ষ উপকরণ সম্পর্কে জ্ঞাত, তাদের দিয়ে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিদ্যমান সাধারণ আইসিটি প্রশিক্ষণ শুধু কিছু হার্ডওয়্যার এবং সফ্টওয়্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় সাধনে ন্যূনতম ধারণাও প্রদান করা হয় না। তাই, অনেক শিক্ষকের মধ্যে একটি প্রযুক্তি-ফোবিয়া কাজ করে যা তাদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদানে বাধা প্রদান করে। তাদের ইন্টারাক্টিভ টিচিং এফিশিয়েন্সি বা মিথস্ক্রিয় শিক্ষাগত দক্ষতার জ্ঞান প্রদান করে স্বাভাবিক প্রযুক্তি, নিম্ন-প্রযুক্তি এবং উন্নত প্রযুক্তি পদ্ধতির আলোকে শিক্ষক নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তারা শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি উপযুক্ত নেতৃত্ব স্থাপন করতে পারেন। যদি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের পাঠ প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্তসার সম্পর্কে শিক্ষকদের একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়, তাহলে তারা শিক্ষা সমাজে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেন। ফলে তাদের নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং নিউ নরমালের শিক্ষা ধারায় তাদের সফল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

শিক্ষকদের অবশ্যই এমন একটি সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে, যার প্রতি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আস্থা তৈরি হয় এবং শিক্ষণ কর্মে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কার্যকরি ভূমিকা পালনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। প্রায়শই, ধারণা করা হয় যে, নেতৃত্বের পদগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা অফিসার, অধ্যক্ষ এবং বিদ্যালয়ের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কথাটি অনেকাংশেই সত্য হলেও আমরা যদি এই ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন পদ্ধতি বা শ্রেণিবদ্ধ মডেল থেকে বেরিয়ে এসে অন্যান্য শিক্ষকদের নেতৃত্বের ক্ষমতা উন্নত করতে পারি তাহলে শিক্ষায় শিক্ষকদের সঠিক নেতৃত্ব প্রতিফলিত হবে এবং শিক্ষার মান নিশ্চিত করার পথ আরও সুগম হবে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, যে সব শিক্ষক তাদের অধ্যক্ষ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ক্ষমতায়িত হয়েছেন, তারা শুধু ছাত্র এবং বিদ্যালয়েরই নয়, বরং অন্যান্য কমিউনিটির মাঝেও তারা তাদের দৃঢ় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। স্বশাসিত সিদ্ধান্ত নিতে এবং পুরোপুরি পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য শিক্ষকদের বিশ্বাস করা অপরিহার্য। পারস্পরিক বিশ্বাস শিক্ষাঙ্গনে একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে দারুণ ভূমিকা পালন করে।

ম্যাককিন্সির এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল: ‘মানব প্রকৃতি যা, তাই, মানুষ যদি ব্যর্থ হওয়ার বিকল্প হিসাবে নিরাপদ কোন সুযোগ তৈরি করতে না পারে, তাহলে তারা ঝুঁকি এড়ানোটাকে পছন্দ করে থাকে।” তদ্রুপ, শিক্ষকরাও ব্যর্থ হওয়ার বিকল্প কোন সুযোগ না দেখতে পেলে, তারা কর্মক্ষেত্রে কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায়, শিশুদের ভবিষ্যত যেখানে জড়িত শিক্ষকরা সেখানে ব্যর্থ হওয়ার কোন কথা চিন্তা না করেই যে কোন মূল্যে শিশুদের মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

শিক্ষকদের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব শিক্ষার্থীদের অনুগত ও আস্থাশীল হতে শেখায়। এটি একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের থেকে বিরত রেখে পারস্পরিক আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। যোগাযোগের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি বিশ্লেষণমূলক প্রক্রিয়া যা সমস্যা নির্ণয় ও তার সমাধানের যৌক্তিক উপায় খুঁজে বের করতে এবং সমাধানের অনেকগুলো বিকল্প থেকে উত্তম ও কল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করে। একজন শিক্ষক যখন একটি নিরাপদ এবং গঠনমূলক পরিবেশে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তখন সবার মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি উন্নত হয় এবং নতুন কিছু শেখার সুযোগ উন্মুক্ত হয়।

শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করলে সবার মধ্যে আত্মসমালোচনামূলক মূল্যায়ন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষক নেতৃত্বের এ ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনে সমস্যা নির্ণয় করা এবং সবার যৌথ প্রচেষ্টায় তা সমাধানের উপায় বের করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের একাডেমিক দায়িত্বের পাশাপাশি প্রশাসনিক অনেক দায়িত্ব থাকে। প্যারেন্টসদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা, বোর্ড বা শিক্ষা অফিস সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত থাকা, মার্কেটিং বা প্রতিষ্ঠানের প্রমোশল কাজে অবদান রাখা ইত্যাদি অনেক কাজ শিক্ষকদের করতে হয়। সরকারি বিদ্যালয়ে, শিক্ষকদের নিয়মিত কাজ সম্পাদন করা ছাড়াও ভোটারদের তালিকাভুক্ত করা, মানচিত্র জোগাড় করার ক্ষেত্র তৈরি করা, আদমশুমারি করা, স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা জরিপ করা ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতে হয়, যা রীতিমতো শিক্ষক নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।

প্যান্ডামিকের বর্তমানের এ শিক্ষা ধারায় অনলাইন টিচিং-লার্নিং সম্পন্ন করতে শিক্ষকদের আরেকটি নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। এমন ক্ষেত্রে যুবক শ্রেণীর স্মার্ট শিক্ষকদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে অনেক লোড নিতে হয়েছে। আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে শিক্ষার ধারা অব্যাহত রাখতে শিক্ষকদের নতুন নেতৃত্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রিমোট এরিয়াতে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে শিক্ষাদান নিশ্চিত করা আরও বেশি কষ্টসাধ্য। শিক্ষা কার্যক্রমের সব বিভাগে নিয়মিত ক্লাস করা, পরীক্ষা নেয়া, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও শ্রেণীভিত্তিক মূল্যায়ন করা ইত্যাদির সব কিছু শিখন-শিক্ষণে ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে সম্পন্ন করা শিক্ষকদের নেতৃত্ব কৌশলের আরেকটি দিক।

অতএব, করোনাকালীন এ সময়ে আমাদের শিক্ষা ধারায় শিক্ষকদের নেতৃত্ব হতে হবে অত্যন্ত চৌকস ও প্রযুক্তিবান্ধব, যা আমাদের আগামী প্রজন্মকে তাদের উন্নত ক্যারিয়ার গঠনে সাহায্য করবে। শিক্ষাদান প্রক্রিয়া হতে পারে তা অনলাইন বা অফলাইন, যদি শিক্ষক নেতৃত্বের মানোন্নয়ন ফলপ্রসূ হয়, তাহলে সেটি হবে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় শিক্ষকদের কৃতিত্ব অর্জন। আমাদের শিক্ষক সমাজকে আধুনিক প্রযুক্তিকে ধারণ করে ডিজিটাল বিপ্লবে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে এবং করোনার এ বিপর্যয় মোকাবিলায় কমিউনিটি বা শ্রেণিভিত্তিক নেতৃত্বের কৌশল যুগোপযোগী করে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

[লেখক : মাহমুদুল হাছান,প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

সূত্র : ১৩ জুলাই, দৈনিক সংবাদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047998428344727