বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বটে, তবে বাংলাদেশ কি ভালো চলছে? প্রতিদিন বাংলাদেশের কোন স্তরের মানুষ জীবন দিয়ে কী অনুভব করছে? এ কথা ঠিক যে কিছু লোক অনুভব করেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কায়েম হয়েছে এবং দেশ খুব ভালো চলছে। কিন্তু সেটা কয়জনে অনুভব করতে পারছেন? বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় ফল খুব ভালো করছে, সন্দেহ নেই। এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি অনেকেই লাভ করছেন। এ নিয়ে সরকারের গর্ব প্রকাশের অন্ত নেই। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কি বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভালো? আমার উপলব্ধি অনুযায়ী মোটেই ভালো নয়। ভলো নয়, ভালো করার জন্য নানা পরিবর্তন দরকার—এ কথা কিছু লোকে বলছেন। প্রচারমাধ্যম সেগুলোকে অল্প গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতির তিনটি লক্ষ্য থাকা উচিত—
এক. সারা দেশে বিভিন্ন ধারার পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তমসংখ্যক যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত চরিত্র বলসম্পন্ন কর্মী সৃষ্টি করা;
দুই. শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তিমান উন্নতিশীল রাষ্ট্র রূপে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার ও ভালোভাবে পরিচালনা করার উপযোগী শিক্ষিত লোক তৈরি করা; এবং
তিন. দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ইত্যাদি থেকে প্রকৃত জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশের চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা এই তিনটি লক্ষ্যের একটির প্রতিও যত্নবান নয়। প্রথম লক্ষ্য অবহেলিত। দ্বিতীয় লক্ষ্য অবহেলিত। বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার ইচ্ছা ও চেষ্টা শাসক শ্রেণিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণের আগ্রহ ও চেষ্টা দিন দিন বাড়ছে। তৃতীয় লক্ষ্য অবহেলিত। বাংলাদেশের বর্তমান শিল্পনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশের প্রতিকূল। বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার পাঁচেক বই প্রকাশিত হয়। যে ভাষায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশবসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, রোকেয়া, লুৎফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলি, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ লিখেছেন, সেই ভাষায় আজ যাঁরা লিখছেন তাঁদের মধ্যে কি পূর্ব-সাধকদের গুণাবলির কোনো রেশ খুঁজে পাওয়া যায়? স্বাধীন বাংলাদেশে গত প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী যাঁদের লেখা, চিন্তা, বক্তৃতা-বিবৃতি সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ। নারী ও ধর্ম বিষয়ে আহমদ শরীফের লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতিও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। শওকত ওসমানের ‘শেখের সম্বরা’ জাতীয় লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতি উসকানিমূলক হয়েছে এবং তরুণদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয় লেখক আরো আছেন। জনপ্রিয় লেখা ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা-বিবৃতি দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশে গত অর্ধশতাব্দী ধরে তরুণদের কী মন তৈরি হয়েছে? জনপ্রিয় ধারার বাইরে প্রকৃত মূল্যবান কিছু রচিত হয়েছে কি না, তা তলিয়ে দেখার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। এই অর্ধশতাব্দীতে এমন কোনো পত্রিকা জনপ্রিয় হয়নি, যার জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনমূলক কোনো ভূমিকা আছে। যে বুদ্ধিজীবীরা সমাজের অভিভাবকের আসন নিয়ে জাতির পথপ্রদর্শক রূপে কাজ করেছেন, তাঁরা কোনো উন্নত চিন্তাচেতনার পরিচয় দেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকায় প্রশংসনীয় কী আছে? বাংলাদেশের ভালোর দিকে চলার জন্য বর্তমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তো আদৌ উপযোগী নয়।
পঞ্চম শ্রেণির ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছে। কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি শিশু-কিশোরদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছে। যেখানে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক অবলম্বনে ও লেভেল, এ লেভেল চালাচ্ছে, সেখানে ইংলিশ ভার্সন চালু করার দরকার কী। সরকার বাংলাদেশে জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের বিবেচনা বাদ দিয়ে ইংলিশ ভার্সন চালিয়ে যাচ্ছে। এর কুফল যখন স্পষ্ট হবে, তখন বাংলাদেশ এক প্রতিকারহীন দুরবস্থায় পড়ে যাবে। সে অবস্থায় বাংলাদেশের দুর্গতির প্রভাবে ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে সেমিস্টার পদ্ধতির নামে যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তা-ও জাতীয় শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব হারাচ্ছে এবং রাষ্ট্রভাষা রূপে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। রাষ্ট্রভাষা মানে শুধু অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ নয়, আরো অনেক কিছু। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার ভাষা তো বটেই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ সরকারি লোকদের মধ্যে দুর্লভ। সাম্রাজ্যবাদীরা যে নীতি নিয়ে বৈশ্বিক ব্যাপারগুলো চালায়, তাকে এককথায় বলা যায় ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি।’ এই নীতি নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি পরিচালিত হচ্ছে। কার্যত বিশ্বব্যাংক পরিচালনা করছে বিশ্বব্যবস্থা। এরই নাম বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর।
এ মাসেই ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকার এক বিরাট প্রকল্প কার্যকর করা হচ্ছে। ব্যাপারটি ভেবে দেখার মতো। সারা দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবক, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা, লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী সবারই উচিত ব্যাপারটাকে বুঝে দেখা। আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি নিয়েই কি সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নের ঘোষণা নিয়ে কোনো দুরভিসন্ধি হাসিল করার জন্য এগিয়ে এসেছে? তারা তো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এক খারাপ থেকে নতুন আরেক খারাপের দিকেই নিয়ে যায়! ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানকালে এবং বাংলাদেশকালে এ ব্যাপারটিই বারবার দেখা যাচ্ছে! দূরদর্শিতার সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করার এবং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করার ব্যাপারে সর্বমহলে সচেতনতা ও সতর্কতা কি দরকার নয়? সামনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন।
একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে এসংক্রান্ত একটি বিবরণ এখানে উদ্ধৃতি করছি—
“নির্বাচনী বছরে শিক্ষা খাতে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। ‘মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন’ কর্মসূচি নামে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। যৌথভাবে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। কিছু ব্যয় সরকারের বাজেট থেকে বহন করা হবে। এর আগে দেশের শিক্ষা খাতের ইতিহাসে এত বড় প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ২০ হাজার স্কুল, ১০ হাজার মাদরাসা ও এক হাজার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ ছাত্র এবং তিন লাখ শিক্ষক উপকৃত হবেন বলে দাবি করা হয়েছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়ে প্রচুর লোকবল নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। গঠন করা হবে একাধিক বিশেষায়িত কমিটি। শুধু এই কর্মসূচির জন্য পৃথক ‘আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ’ নির্দেশনা জারি করবে সরকার। প্রকল্পটি অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এই কর্মসূচির আওতায় মাধ্যমিক ও মাদরাসা—উভয় শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান আরো বাড়ানো হবে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতেও জোর দেওয়া হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো থেকে শুরু করে উপবৃত্তি, প্রণোদনা, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদে পরিকল্পনা-বাজেটের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। সূত্র জানায়, বিশাল এই কর্মসূচির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৭ দশমিক ২০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে) বাজেটের পরিকল্পনা ব্যয় বরাদ্দের আওতায় সরকারের ট্রেজারি থেকে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে। পূর্বনির্ধারিত রেজাল্ট ফ্রেমওয়ার্কের আলোকে ডিএলআই অর্জন সাপেক্ষে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে পুনর্ভরণকৃত অর্থ সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হবে।”
এই প্রকল্পের অর্থায়ন সম্পর্কে পূর্বোক্ত বিবরণে আরো বলা হয়—
“এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দেবে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার, এডিবি দেবে সাড়ে ২২ কোটি মার্কিন ডলার, বিশ্বব্যাংক ঋণের অতিরিক্ত আরো এক কোটি ডলার জিএফএফ গ্র্যান্ট কারিগরি সহায়তা হিসেবে দেবে। প্রকল্প ব্যয়ের বাকি টাকা আসবে সরকারি কোষাগার থেকে। এ ছাড়া ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউনিসেফ, ইউনেসকো, ডিএফআইডি ও ইউএনএফপিএ এই কর্মসূচিতে কারিগরি সহায়তা দেবে। প্রস্তাবিত এই কর্মসূচিতে মাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এই কর্মসূচির সাধারণ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অংশ বাস্তবায়ন করবে। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ মাদরাসা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে। প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির মূল তিনটি রেজাল্ট-এরিয়া রয়েছে। প্রথমত, এনহান্সড কোয়ালিটি অ্যান্ড রেলেভ্যান্স অব সেকেন্ডারি এডুকেশনের আওতায় কারিকুলাম উন্নয়ন ও শিক্ষাকে শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানো। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও আইসিটি বিষয়ে শিখন-শেখানো পদ্ধতি উন্নয়ন। পাঠাভ্যাস উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং শিক্ষা কার্যক্রমে আইসিটির ব্যবহার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। দ্বিতীয়ত, ইমপ্রুভড অ্যাকসেস অ্যান্ড রিটেনশনের আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি (উপবৃত্তি দেওয়া, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি) করা হবে। সুযোগবঞ্চিত এলাকায় শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার বৃদ্ধির (বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা তথা পুরস্কার সচেতনতা বৃদ্ধি, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা ইত্যাদি) কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। তৃতীয়ত, স্ট্রেংদেনড গভর্ন্যান্স, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের আওতায় শিক্ষাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় চারটি শর্ত দিয়েছে। বলা হয়েছে, কর্মসূচির মোট ব্যয় এক লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা সম্ভাব্য ব্যয়সীমা হিসেবে বিবেচিত হবে। মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় দেওয়া ব্যয়সীমার মধ্যে সংকুলানসাপেক্ষ প্রকৃত প্রয়োজনের নিরিখে বাজেটে প্রস্তাবিত কর্মসূচির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে। বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দের স্কিমের আওতায় দেওয়া হবে। এই কর্মসূচির আওতায় যেসব স্কিম গ্রহণ করা হবে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ করার জন্য অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হবে।”
সব পত্রিকায়ই এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বোঝা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই মাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদির উন্নয়নের নামে এক মহাযজ্ঞ বাংলাদেশে আরম্ভ হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউনেসকো, ইউনিসেফ ইত্যাদির সহযোগে এক মহাকাণ্ড আরম্ভ হতে যাচ্ছে। কী করা হবে এত টাকা দিয়ে? কিভাবে খরচ করা হবে এই বিরাট অঙ্কের টাকা? টাকাটাই বড় কথা নয়, কী ফল হবে টাকা খরচের। ঘোষিত ও অঘোষিত কী কী লক্ষ্য থাকবে এই এলাহি কাণ্ডের পেছনে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই দেখছি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অত্যন্ত তৎপর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কর্মনীতি তুলনামূলকভাবে উদার ছিল। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকের সূচনা থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্বকালে সাম্রাজ্যবাদী কর্মনীতি অনেক বেশি জটিল, কুটিল, দুর্বল জাতিগুলোর এবং সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। যে এলাহি কাণ্ড বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে আরম্ভ হতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখার লোক কোথায়? বাংলাদেশের যাঁরা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে এসব কর্মকাণ্ডে থাকেন, ডক্টর-প্রফেসর—তাঁরা সাধারণত সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকেই বড় করে দেখেন, বাংলাদেশের স্বার্থকে নিতান্ত গৌণ মনে করেন। সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর বুদ্ধিজীবীরা, এনজিওপতিরা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেরই ধারক-বাহক ও রক্ষক। এমনকি সরকারি প্রশাসকরাও প্রকল্পে জড়িত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেরই অনুকূলে কাজ করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন ধারার রাষ্ট্রীয় শিক্ষা নিয়ে যে এলাহি কাণ্ড আরম্ভ হতে যাচ্ছে, তাকে সামনে নিয়ে এসব কথা আমার মনে জাগছে। সরকার কি জাতীয় স্বার্থ, জনস্বার্থ দেখবে। বাংলাদেশে যে উন্নয়নের জোয়ার চলছে, আসন্ন এই এলাহি কাণ্ডও সেই জোয়ারেরই অংশ। দেশের জনগণ যখন ঘুমিয়ে আছে, জাতি যখন অনৈক্যের মধ্যে কলহ-কোন্দলে ও হিংসা-প্রতিহিংসায় মত্ত, রাষ্ট্র যখন সব দিক দিয়ে শ্লথ-শিথিল, আর সাম্রাজ্যবাদী সব সংস্থা ও শক্তি যখন বিশ্বায়নের নামে অতি তৎপর, তখন আমাদের রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবনের অনুকূল শিল্পনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে কিভাবে? জনগণের রাজনৈতিক দল, রাজনীতি ও সরকার লাগবে। সেদিকে কেন্দ্রীয় মনোযোগ দরকার। শুধু ভোটের উৎসব দিয়ে সেদিকে যাত্রা হবে না।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ