শিক্ষাপঞ্জির সমন্বয় কীভাবে

মাছুম বিল্লাহ |

চলতি বছরের শিক্ষাপঞ্জি আবারও বড় এক ধরনের ধাক্কা খেলো। শেষ ধাক্কাটির জন্য আমরা কেউ প্রস্তত ছিলাম না। এর জন্য এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই, বিশেষ করে আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং পুরো শিক্ষাচক্র। কীভাবে তা সমন্বয় করা হবে সেটিই এখন দেখার বিষয়। 

দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না।  তাড়াহুড়ো করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে আবার সমস্যা সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। আগে পরিবেশ তৈরি করা হবে। শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে।

সেটি কবে আমরা কেউ তা জানি না। তবে এটি বুঝি, শিক্ষার্থীরা এক বিশাল ক্ষতির মুখে পড়লেন। করোনা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগ এবং সিন্ধান্ত নেয়ায় অবহেলা এবং বিলম্ব করার কারণে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ইতোমধ্যে বড় এক লার্নিং গ্যাপের মধ্যে আছে। আর এক স্তরের গ্যাপের সঙ্গে অন্যান্য সব স্তর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। কাজেই মাধ্যমিকের যে সমস্যা ও ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়েছে এবং হতে চলেছে তার সঙ্গে পরবর্তী স্তরগুলো সরাসরি সম্পৃক্ত অর্থাৎ সে স্তরগুলোও সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে যদি  আমরা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারি।

মাধ্যমিকের ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন গত বছর হয়েছে জুন-জুলাইয়ে। এবার নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা, গাফিলতি, শিক্ষার্থী শিক্ষক ও অভিভাবকদের এক সাসপেন্সের মধ্যে রাখার কারণে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন কবে হবে, কীভাবে হবে তার কোনো তারিখ ও পন্থা ঠিক করতে করতেই জুলাই পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের সিডিউল চারবার পরিবর্তনের ফলে সর্বশেষ এসে ঠেকেছিলো ৩ জুলাই এবং শেষ হওয়ার কথা ৩ আগস্ট। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে ১৮ জুলাই থেকে অর্থাৎ মাঝপথে সব পরীক্ষা বন্ধ যায়। যে পরীক্ষার কথা কর্তৃপক্ষ এক বছরেও ঠিক করতে পারেনি সেই অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা আবারও এক অনিশ্চয়তার মধো আছেন যে, কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে, কবে আবার নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে এবং সে পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মুড কতোটা থাকবে। কোথাও কোথাও দশম শ্রেণির প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষাও শুরু হয়েছিলো, সেটিই বা বিদ্যালয়গুলো কীভাবে ম্যানেজ করবে?  

বর্তমানে আর একটি বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। আগামী ১ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। নতুন তারিখ পরে জানানো হবে। প্রতিবছর ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু করোনাকালীন প্রভাবে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের পরীক্ষা পিছিয়ে গত ৩০ জুন থেকে শুরু করা হয়। এরপর আবার বন্যার কারণে সিলেট বিভাগের পরীক্ষা ৮ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিলো। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার বড় ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, এইচএসসি উত্তীর্ণরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আগে সাধারণত জুলাই মাসের মধ্যে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হতো। এরপর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতো। কিন্তু চলতি বছর যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে পরীক্ষা শেষ করে ফল প্রকাশ করতেই অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত লেগে যাবে। ফলে সব প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। এতে এই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের সেশনজটে পড়তে হবে। আর সেই ধাক্কা গিয়ে লাগবে প্রতিটি সেশনে। 

গত ১২ জুলাই একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৫ থেকে ২৫ জুলাই ছিলো একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সময়সীমা। আর ৩০ জুলাই থেকে ক্লাস শুরুর কথা ছিলো। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে গত ১৭ জুলাই থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রমও স্থগিত হয়ে যায়। এ পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে দেখা যায় যে, ২৮ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ভর্তির নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ৬ আগস্ট থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে সব ঠিক থাকলেও এর বিলম্বের ধাক্কা গিয়ে লাগবে পুরো শিক্ষাপঞ্জিতে। আগাতে পেছাতে হবে উচ্চশিক্ষার পঞ্জিও।

সহিংসতা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউনের সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ থেকে গত কয়েকদিনে সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী ভারতে ফিরেছেন। বিহার, ঝাড়খন্ডের বাসিন্দাসহ অধিকাংশই বাঙালি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নেপাল, ভুটান, মায়ানমারের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে আসেন এবং তারা অধিকাংশই এমবিবিএস পড়েন। যারা রাষ্ট্রচালিত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারেন না তারা বেসরকারিতে ভর্তি হন। কিন্তু ভারতে যেকোনো বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে গেলে প্রয়োজন হয় ৮০ লাখ থেকে কোটি টাকার ওপর যা অনেক অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তারা তাদের সন্তানদের চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পাঠিয়ে থাকেন। এটি একটি বিরাট পজিটিভ সাইড। কিন্তু ভয় হচ্ছে- যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং নাইটমেয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে এখানেও ভাটা পড়ে কি না।

প্রতিবছরের শুরুতে একটি শিক্ষাপঞ্জি তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী বছরজুড়ে চলে ক্লাস-পরীক্ষা। কিন্তু চলতি বছর নতুন শিক্ষাক্রম এবং প্রথমে বন্যার কারণে পিছিয়ে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম। এরপর আবার গত ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতির কারণে বন্ধ হয়ে যায় ক্লাস ও পরীক্ষা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও অস্থিরতা বর্তমানে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ওলটপালট হয়ে গেছে শিক্ষাসূচি। যার কারণে বড় ধরনের সেশনজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে । বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও বলছে, ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশনজটের মধ্যে আছে। কারণ, করোনায় সৃষ্ট সেশনজট এখনো চলছে। এরপর আবার শিক্ষকদের আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে বড় ধরনের সেশনজট তৈরি হতে যাচ্ছে। সেশনজট না থাকায় বর্তমানে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলে। আবার অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি ক্লাস নেয়া সম্ভব না হলে অনলাইনে ক্লাস নেয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় চলতি মাসে জুলাই-ডিসেম্বর সেমিস্টারের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। সেই পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ বিকল্প উপায়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রেও বড় ঝুঁকি সৃষ্টি হলো।  

সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে নামেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এতে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জোরদার হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। শিক্ষকদের কর্মবিরতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শিক্ষাঙ্গনে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষা কার্যক্রম। ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে অনেক পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। এদিকে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এতে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা, অর্ধবার্ষিক বিভাগীয় পরীক্ষা (জুন-২০২৪), নন-ক্যাডারের স্টাডার্ন্ড অ্যাপটিচুড টেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরবর্তী চাকরি সংক্রান্ত বিষয়াদিসহ সবকিছুই ঝুঁকি এবং এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া এই স্থবিরতা ও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঘুষকাণ্ড চাপা দিয়ে স্কুল অডিটে মনকিউল - dainik shiksha ঘুষকাণ্ড চাপা দিয়ে স্কুল অডিটে মনকিউল শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার, জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার - dainik shiksha শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার, জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার মাউশি কমকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে লিয়াকত-অহিদুর - dainik shiksha মাউশি কমকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে লিয়াকত-অহিদুর নবম-দশমের পাঠ্যবইয়ের চাহিদা আপলোডের নির্দেশ - dainik shiksha নবম-দশমের পাঠ্যবইয়ের চাহিদা আপলোডের নির্দেশ ক্ষমতায় গেলে ফরম থেকে কে কোন ধর্মের সেই প্রশ্ন তুলে দেয়া হবে - dainik shiksha ক্ষমতায় গেলে ফরম থেকে কে কোন ধর্মের সেই প্রশ্ন তুলে দেয়া হবে ডাকসুতে প্যানেল বাতিলসহ ৮দফা প্রস্তাবনা ইউআরআই‘র - dainik shiksha ডাকসুতে প্যানেল বাতিলসহ ৮দফা প্রস্তাবনা ইউআরআই‘র কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028760433197021