শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপি রুহুলের নিয়োগ বাণিজ্য

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি |

কুড়িগ্রাম-৪ আসনের (রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলা এবং চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার অংশবিশেষ) সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির (জেপি) রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কেবল শিক্ষা  খাতেই ১০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন এমপি।

নির্বাচিত হওয়ার পর রুহুল আমিন কিছুদিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন। এলাকার উন্নয়নে দল-মত-নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা চান তিনি। কিন্তু তিন-চার মাস পরই তাঁর আসল রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ঘুষ ছাড়া কোনো প্রকল্পই কাউকে বরাদ্দ দেননি তিনি। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এলাকার ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন নিজেই। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁর স্বজন ও নিজস্ব লোকদের সভাপতি বানিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন।

২০১৪ থেকে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে এমপি ১০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ মিলেছে। জানা গেছে, এমপি নিজেই রাজীবপুর ডিগ্রি কলেজ, নয়াচর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা, রৌমারী ডিগ্রি কলেজ, রৌমারী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, দাঁতভাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যাদুরচর মডেল কলেজ, যাদুরচর মহিউসুন্নাহ আলিম মাদরাসা, রৌমারী কেরামতিয়া ফাজিল মাদরাসা, নুরপুর দাখিল মাদরাসা, কলাবাড়ী বিবিসি উচ্চ বিদ্যালয়, বকবান্দা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদ দখল করে নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন। সহকারী শিক্ষকপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ আর প্রতিষ্ঠানপ্রধান পদে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন তিনি। ওই অভিযোগ নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে।

চাকরিপ্রার্থীসহ এলাকাবাসীর অভিযোগ, রৌমারীর বকবান্দা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ভুয়া সনদধারী জুনিয়ার শিক্ষক আব্দুর রহমানকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। বিনিময়ে আব্দুর রহমানের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নেন এমপি রুহুল আমিন। এরপর সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আয় করেন আরো ৫০ লাখ টাকা। ওই নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা করে এলাকাবাসী। একইভাবে টাপুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ে কলেজ শাখা সৃষ্টি করে ৩৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এমপি অবৈধভাবে আয় করেন সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি।

বকবান্দা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহীদুল ইসলাম সালু বলেন, পরিচালনা কমিটির সভাপতি থাকার সময় এমপি রুহুল আমিন ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রধান শিক্ষক পদে আব্দুর রহমানকে নিয়োগ দেন। এটা এলাকার সবাই জানে। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রও ফাঁস করে দেওয়া হয় তাঁকে। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল বারী ও কারি আশরাফ আলী অভিযোগ করেন, আব্দুর রহমানের বিএসসি সনদপত্র ভুয়া। তা ছাড়া সম্পূর্ণ অবৈধ উপায়ে ওই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে আদালতে মামলাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়া আছে।

যাদুরচর মডেল কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আজিজুর রহমান বলেন, ‘নিয়োগের কথা বলে সব প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেন এমপি। শেষ পর্যন্ত যে প্রার্থী বেশি টাকা দেন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমিও টাকা দিয়েছিলাম।’

টাপুরচর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম বাদল বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এমপি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু টাপুরচর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তিনি সাড়ে তিন কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন।

রাজীবপুরের নয়াচর ইসলামিয়া আলিম মাদরাসায় শিক্ষক পদের প্রার্থী শামসুল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘এমপি সাহেব আমিসহ আরো তিনজনের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষের ছেলের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে আমাদের বাদ দিয়েছেন। এখনো সব টাকা ফেরত দেয়নি।’

যাদুরচর মহিউসুন্নাহ দাখিল মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘আমাদের এই মাদরাসাটি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার পেছনে এমপির হাত রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে বহিষ্কৃত সুপার শহীদ মাসউদ আহমেদকে আবারও ওই পদে বসান। ওই সুপারের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর বিল-বেতন এখনো বন্ধ রয়েছে।’

এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর রুহুল আমিন যাদুরচর হাই স্কুল সড়কে চারতলা আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাসাবাড়ি করার জন্য জমি কিনেছেন কুড়িগ্রাম ও রংপুর শহরে। রৌমারী উপজেলার বেহুলারচর এলাকায় কিনেছেন ১২ বিঘা আবাদি জমি, যার বর্তমান বাজার মূল্য অর্ধ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে কয়েক শ কোটি টাকা নগদ জমা রেখেছেন বলে জানা গেছে তাঁর নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে। এমপির কোটায় শুল্কমুক্ত পাজেরো গাড়ি কিনে তা বিক্রি করে লাভ করেন দেড় কোটি টাকারও বেশি। আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যবসায়ী এমপির নামে গাড়িটি কিনে নেন বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে রুহুল আমিন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে ১০ কোটি টাকা নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। যাদুরচর হাই স্কুল সড়কে যে চারতলা বিশিষ্ট পাকা বাড়ি সেটা আমার নয়। আমার মেয়ের জামাই বাড়িটি করেছে। আমি তাতে একটু সহযোগিতা করেছি। বেহুলারচরে ১২ বিঘা জমি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিনেছে। কোনো ব্যাংকে আমার নামে কোনো অর্থ জমা নেই। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমার এক আত্মীয়কে দিয়েছি বিক্রি করা হয়নি। আপনারা খালি দোষ ধরে বেড়ান। আমি এমপি হয়ে এলাকায় যে উন্নয়নমূলক কাজ করেছি সেটা তো লেখেন না।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004464864730835