শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার জনগণের সন্তানরা পড়াশোনা করে থাকেন। শিক্ষক সমাজ সকলের। শিক্ষকের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকা কাম্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তাদের হওয়া উচিত সর্বজনীন। কিন্তু এ সর্বজনীন দৃশ্য খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদেরও রঙ পাল্টাতে বাধ্য হয়। নানাবিধ কারণে যখন সে সরকার থাকে সে সরকারের পুতুল হতে বাধ্য হয়। চাকরি ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ আর্থিক দৈন্যতাই হলো এর প্রধান কারণ।
এ প্রসঙ্গে চলচিত্রের একটা লাইন মনের মাঝে ভেসে উঠলো-‘যেমনি নাচায় তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ?
এলাকার অতি উৎসাহী উৎশৃঙ্খল লোকজন বিধি নিষিধের তোয়াক্কা করে না। তারা মনে করেন, মহল্লা তাদের, দল ক্ষমতায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তাদের অনুগ্রহে চলবে। শিক্ষকেরা যে জাতি গড়ার কারিগর, সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি এই উপলব্ধিবোধ তাদের মাঝে জাগ্রত হয় না। তারা শিক্ষকদের অনেকটা তাদের ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে গণ্য করে থাকেন। এবার শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের নিরাপত্তার বেষ্টনী ভেঙে অটোপাস আদায় করে নেয়। যদিও বৈষম্যমূলক ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা অটোপাসের তীব্র বিরোধিতা করেন। সে গানের কলি আবারও ভেসে ওঠে, সচিবালয়ের ফটক অতিক্রম করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর দাবির মুখে শিক্ষা উপদেষ্টা তথা সংশ্লিষ্টরা অনেকটা পুতুল ব্যতিত কিছুই নয়। রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিগত সম্পদ, থানায় ভাঙচুর, আগুন লুটপাটের, হত্যার ঘটনা নিরপেক্ষ বিচার হবে এই প্রত্যাশা সাধারণ জনগণের। শিক্ষকেরা এই সমাজেরই মানুষ। তাদের দোষ-ত্রুটি থাকতেই পারে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। দোষী হলে তাদের শাস্তি হবে এ প্রত্যাশা সকলের। অথচ সারা দেশে কিছু বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটছে। এই ব্যাপারে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মর্মাহত। বেশির ভাগ ১৮ বছরের নিচে শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পর তারা দলগতভাবে শিক্ষকদের স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে। বিচারবহির্ভূত এই অপমান শিক্ষক সমাজ তথা জাতির। এই বিচারহীনতা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। সব সরকারের আমলে সচিব, কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বেশিরভাগ মানুষ স্বার্থ ও নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের রূপ পাল্টায়। না পাল্টিয়ে জীবনধারণ তথা সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা দায়। এ অবস্থার পরিবর্তন কাম্য। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে রাষ্ট্র তথা সমাজকে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের, সরকারি কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্যতিরেকে দেশের বেসরকারি সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নানা আর্থিক বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় সামাজিক মর্যাদায় পর্যদুস্ত। রাজনৈতিক বলয় থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সব শিক্ষকের মর্যাদা নিতে হবে প্রথম শ্রেণির। মর্যাদার পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে পরিচালনা কমিটির নাম পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ম্যানেজিং বা পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে কর্তৃত্ব বা প্রভুত্বমূলক ভাবনা জড়িত।
তাই এই ভাবনা থেকে দূরে থাকার মানসে সেবার বা কল্যাণের মনোবৃত্তি জাগ্রত করার লক্ষ্যে ‘বিদ্যালয় কল্যাণ কমিটি’ নামকরণের প্রস্তাব করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ থেকে মুক্ত থাকে। এ লক্ষ্যে শুধু জমি দাতা বা তার পোষ্যকে সদস্য করা হোক। পাশাপাশি সব শিক্ষক থাকবে বিদ্যালয় কল্যাণ কমিটির সদস্য। এ ছাড়া প্রত্যেক শ্রেণির একজন অভিভাবক সদস্য থাকবেন। প্রধান শিক্ষক কমিটির আহ্বায়ক বা সভাপতি। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সরকারি বিধি-বিধানের আলোকে বিদ্যালয়ের কল্যাণে কার্যক্রমের ব্যবস্থা নেবেন। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও শিক্ষকমণ্ডলী বিদ্যালয়ে কল্যাণের চ্যালেঞ্জগুলো ভালো জানেন। তারা সহজে বিদ্যালয়ের সমস্যা দূর করতে সক্ষম হবেন। বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিদ্যালয় কল্যাণের পাশাপাশি তার রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তথা শিক্ষকদের রাজনীতিতে প্রবেশ করান। শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষাসহ রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে বিদ্যালয় কমিটি গঠন হোক আজকের প্রস্তাবনা। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিষয়টি ভাববেন এই প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষাবিদ