সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টাইম স্কেল পাইয়ে দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির নামে মো. দবির উদ্দিন, মো. আব্দুস সালাম ও মাহবুবুর রহমান নামে তিন শিক্ষক সারাদেশে কর্মরত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে এই চাঁদা তুলেছেন। এই তিনজন বিভিন্ন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত। গত দুবছর ধরে এই চাঁদা তোলা হলেও শিক্ষকরা এখন পর্যন্ত টাইম স্কেল সুবিধা পাননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশতাক আহমেদ ১ লাখ ২ হাজার টাকা রূপালী ব্যাংক ঢাকার কাপ্তানবাজার শাখায় মো. দবির উদ্দিন, মো. আব্দুস সালাম ও মাহবুবুর রহমান নামে পাঠিয়েছেন। এই লেনদেনের ব্যাংক রশিদ সংগ্রহ করেছে। পরে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাপকালে তারা এই টাকা লেনদেনের কথা স্বীকার করে বলেন, আদালতে টাইম স্কেল সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য চাঁদা হিসেবে এই টাকা এসেছে। এখানে অন্যায় কিছু নেই বলেও তারা দাবি করেছেন। এই চাঁদাবাজির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সচিব মো. মাহবুব হোসেন শিক্ষকদের ‘তলব’ করেছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে মাউশি সচিব গতকাল বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী টাইম স্কেলের সিদ্ধান্ত হবে। মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারের নতুন আদেশ অনুযায়ী ১০ এবং ৬ বছর পর শিক্ষকরা টাইম স্কেল পাওয়ার কথা। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে শিক্ষকরা তা পাননি। এর বিপরীতে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এতে তাদের বেতন কিছুটা বেড়েছে। তবু টাইম স্কেল সুবিধা পাওয়ার জন্য সারাদেশের প্রায় ১ হাজার ৫৯০ জন শিক্ষক হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলায় কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে শিক্ষকদের পক্ষে রায় আসে। এরপর সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ওই আপিল শুনানির নামে টাকা দিতে হবে- এমন কথা বলে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি সাধারণ শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করে। তাদের কথা মতো শিক্ষকরা টাকা পাঠাতেও শুরু করেন। কিন্তু সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি বরাবর এই টাকা না এনে মো. দবির উদ্দিন, মো. আব্দুস সালাম ও মাহবুবুর রহমান- এই তিনজনের যৌথ নামে ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে।
অনেকেই বলেছেন, সাংগঠনিকভাবে টাকা তুলতে হলে সংগঠনের অর্থ সম্পাদকের নামে তা করা উচিত। কিন্তু তা না করে তিনজনের নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এখানেই তারা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, একটি স্কুল থেকেই যদি লক্ষাধিক টাকা তোলার খবর পাওয়া যেতে পারে তাহলে সারাদেশে চার শতাধিক সরকারি স্কুল থেকে কত টাকা তোলা হয়েছে এবং ওই টাকা কে নিয়েছে?
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশতাক আহমেদ কাছে স্বীকার করে বলেছেন, ১ লাখ ২ হাজার টাকা তিনি রূপালী ব্যাংকে ঢাকার কাপ্তানবাজার শাখায় মো. দবির উদ্দিন, মো. আব্দুস সালাম এবং মাহবুবুর রহমান নামে পাঠিয়েছেন। টাইম স্কেল-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় এই টাকা পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি। মামলার বাদী কে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এতকিছু বলতে পারব না। তবে তিনি পাল্টা প্রশ্নে জানতে চান, এই টাকা পাঠানোর কারণে চাকরির কোনো ক্ষতি হবে কিনা?
চাঁদা গ্রহণকারীদের একজন হচ্ছেন রাজধানীর নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আব্দুস সালাম (যিনি মামলা সালাম নামে পরিচিত) বলেন, শিক্ষক সমিতির সভায় আমাদের তিনজনের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে টাইম স্কেল-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য তাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। কাজেই এই টাকা চাঁদাবাজির নয়, মামলা পরিচালনার জন্যই টাকা তোলা হয়েছে।
আব্দুস সালামের সঙ্গে কথা বলার পরই সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির প্রচার সম্পাদক ও খিলগাঁও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তপন কুমার শীল এ প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে বলেন, সাধারণ শিক্ষকদের কাছ থেকে যে টাকা তোলা হয়েছে তা মামলা পরিচালনার জন্যই। এখানে অন্য কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। অন্য এক প্রসঙ্গে গিয়ে তিনি বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়টি শিক্ষা সচিব জেনে আমাদের ডেকেছিলেন। আমরা গিয়ে তাকেও বুঝিয়ে এসেছি।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শিক্ষা কর্মকর্তা (আইন শাখা) আল আমিন সরকারবলেন, আপিলে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কিছু বলছি না। সরকার এখানে কঠোর বলেও জানান তিনি। চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক কথাই শুনি। কিন্তু কথা বলা বারণ।
তবে মাউশির মাধ্যমিক শাখার উপপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ বলেন, এভাবে চাঁদা তোলা ঠিক হয়নি। আমি নিজেও সরকারি মাধ্যমিকের একজন শিক্ষক। সরকার আমাকে আজ এখানে পদায়ন করেছে। কাল এখানে না রাখলে কোনো স্কুলে যোগ দেব। শিক্ষক হিসেবে সংগঠনে আমাদের চাঁদা মাত্র ২৫ টাকা, তাও অর্থ সম্পাদক বরাবরে তা জমা দিয়ে রশিদ সংগ্রহ করতে হয়। মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, টাইম স্কেলের নামে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।