শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে লেখাপড়া নয়

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

শুধু শিক্ষার্থী নয়, সব বয়সের মানুষের জন্য খেলাধুলা বা ব্যায়ামের পাশাপাশি বিনোদনের প্রয়োজন অপরিসীম। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য প্রবীণদের হাঁটাহাঁটি, চলাফেরা ও ব্যায়ামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নাহলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পরিবারের লোকজনের নিকট আর্থিকসহ শারীরিক অচল অবস্থায় বোঝা হয়ে দিন কাটাতে হবে। এ অবস্থা নিরসনে আর্থিক সচ্ছলতা রাখার অভিপ্রায়ে তাদের পেশা অনুযায়ী কাজের সুযোগ সৃষ্টির অভিপ্রায়ে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রবীণদের দেশ ও পরিবারের বোঝা হিসেবে না ভেবে তাদের দেশের অভিজ্ঞ সম্পদ হিসেবে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের জন্য খেলাধুলা, বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা রাখার প্রয়োজন। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের কর্মরতদের মতো শ্রান্তি বিনোদন ভাতার বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি।

প্রবীণরা তাদের অভিজ্ঞলদ্ধ জ্ঞান দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের গঠনে অবদান রাখবেন এ আশাবাদ রাখছি। খেলাধুলা ও বিনোদন শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক, মেধাবিকাশ, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও শিক্ষাসহ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ এ সুযোগে থেকে সাধারণ মানুষের সন্তানদের বঞ্চিত করে অতি উচ্চবিত্তের সন্তানদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। উচ্চবিত্তের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ১২-২টার মধ্যে শিক্ষার কার্যক্রম শেষ হয়ে থকে। এ শিক্ষার্থীরা তাদের বাড়িতে দুপুরে লাঞ্চ করে ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলবেলা ফুরফুরে মেজাজে খেলাধুলা বা বিনোদন করে থাকেন। তৃণমূলের সরকারি প্রথমিক বিদ্যলায়ের শিক্ষর্থীদের বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শেষ করতে বিকেল গড়িয়ে যায়। এখনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় থেকে খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুরের খাবার খেতে না পেয়ে অনেকটা পেট ও পিঠ এক হয়ে পড়ে। ক্ষুধার তাড়নায় তাদের খাবারের থলি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে। এতে বিদ্যালয় তাদের কাছে আনন্দময় না হয়ে বিতৃষ্ণায় পরিণত হতে থাকে। দুপুরে নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ত্যাগ করতে, অনেক সময় পালাতে দেখা যায়। আর্থিকভাবে সচ্ছল অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের বিন্ডারগার্টেন বা সরকারি-বেসরকারি হাইস্কুলের প্রাথমিক শাখায় ভর্তি করিয়ে থাকেন। প্রতিদিন শিশু শিক্ষার্থীদের ৬-৭টি শ্রেণির কার্যক্রম হয়ে থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল ৯টা থেকে ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। এ সময়সূচি শিখন ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা-বিনোদনের অধিকার হরণসহ শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত শ্রেণির কার্যক্রম করতে হয়।

প্রাথমিকের শিখন ঘাটতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ শ্রেণির কার্যক্রম ৪০-৪৫ মিনিট। এ সময়ে শিক্ষককে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে পড়া বা কাজ দিয়ে পাঠ সমাপ্ত করতে হয়। শ্রেণির কার্যক্রম এক  ঘণ্টা করা হলে শিক্ষক শ্রেণিতেই পাঠদান সমাপ্ত করতে সক্ষম হবেন। এর ফলে শিক্ষার্থীর ওপর বাড়িতে পড়ার চাপ বা কোচিং করে আলাদাভাবে পড়ার প্রয়োজন হবে না। বিদ্যালয় হবে শিক্ষার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। অপরদিকে, দৈনিক তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির সাতটি পিরিয়ডের কার্যক্রমসহ প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয় শ্রেণিতে কার্যক্রম তো রয়েছে। শিক্ষকের ওপর এতো পিরিয়ডের পাঠদানের চাপ বাস্তবে দুই-তিনটা পিরিয়ড করার পর বাধ্য হয়ে পরবর্তী শ্রেণির কার্যক্রম দায়সারাভাবে যেনতেনভাবে বাড়িতে পড়া বা কাজের চাপ দিয়ে শিক্ষক অব্যাহতি নেন। যার ফলে অভিভাবককে কোচিং বা গৃহ শিক্ষক নোট বইমুখী হতে হয়। 

এ বিষয়টি বিবেচনা করে তৃতীয় হতে পঞ্চম শ্রেণিতে সাতটি শ্রেণি কার্যক্রমের পরিবর্তে এক ঘণ্টা করে চারটা করা যুক্তিযুক্ত। আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণি যারা শারীরিক শক্তির শ্রম দিয়ে থাকেন যেমন মাটিকাটা, ইট-পাথর ভাঙা, বোঝা টানা, রিকশা চালানো ইত্যাদি। অথচ আমাদের দেশের কতিপয় নিষ্ঠুর মালিক তাদের একটু বিশ্রামকে সুদৃষ্টিতে দেখে না। তারা মূর্খের মতো ভুলে যাচ্ছেন, ‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসঙ্গে গাঁথা, নয়নের পাতা যেনো নয়নে গাঁথা। বিশ্রামের মাধ্যমে যে কাজের নব কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ বিষয়টি তাদের উপলব্ধিতে আসছে না। তেমনি আমাদের শিক্ষা বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তারা তাদের অফিসিয়াল কাজ ও শিক্ষকতা পেশাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন।

শিক্ষকতার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, একনাগাড়ে দুই তিনটা শ্রেণির কার্যক্রম করার পর ক্লান্তি এসে শরীর ও মনকে নিস্তেজ করে দেয়। শরীর বিশ্রাম চায়। মস্তিষ্ক টগবগে গরম হয়ে পড়ে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের বিশাল ক্ষয় হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ছুটি দেখলে এক শ্রেণির ‘শ্রদ্ধেয়’ কর্মকর্তাদের মন হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে নিমজ্জিত হতে দেখা যায়। শিক্ষকতা একটি কঠিন পেশা। শিক্ষকেরা এ পেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর শিক্ষকতা পেশার খানিকটা অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে শিশুদের নিয়ে ৬ থেকে ১০টি ক্লাস করার অভিজ্ঞতা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কারো আছে বলে দৃশ্যমান নয়। শিশুশিক্ষার মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ সর্বত্র যারা শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করে থাকেন তাদের শিশু মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান নিয়ে আসা প্রয়োজন। শিশু মনোবিজ্ঞান ছাড়া শিক্ষা অনেকটা ‘ছিদ্রথলির ভিক্ষার’ মতো হতে বাধ্য।

শিশুদের জন্য প্রয়োজন শিশুবান্ধব সময়সূচি। এইজন্য দুপুর ২টার মধ্যে শিশুশিক্ষার কার্যক্রম শেষ করার প্রয়োজন। দুপুরে বাড়িতে গরম খাবার খাওয়া, গোসল করা, বিশ্রাম বা ঘুমানো আর বিকেলবেলা খেলাধুলা বা বিনোদন করা শিশু ও শিক্ষার্থীর অধিকার। অথচ তাদের অধিকার হরণ করে চলছে প্রাথমিক শিক্ষা।

প্রতিবছরের মতো এ বছরও রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ড কাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি যখনই সরকারে এসেছেন তখনই চেষ্টা করেছেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার প্রতি আরো বেশি অনুরাগী করে তুলতে। কেনোনা খেলাধুলা মানুষের শারীরিক মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটায়। পাশাপাশি শৃঙ্খলা শেখায়, আনুগত্য শিক্ষা দেয় এবং সেই সঙ্গে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। খেলাধুলার মধ্য দিয়েই আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে পারি। তিনি আরো বলেন, সব ধরনের খেলাধুলার বিকাশে তার সরকার প্রতিটি উপজেলা একটি করে মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছে, যাতে প্রত্যেকটি উপজেলাতে খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনা বলেন, আমি চাই আমাদের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, শরীর চর্চা ও সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেদের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলবে।

প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ খেলায় নৈপুণ্য পরিদর্শনের জন্য বক্তৃতার শুরুতেই খুদে খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানান। দুইটি টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি প্রচণ্ড তাপের মধ্যে খেলার কারণে কোমলমতিদের শারীরিক কোনো সমস্যা হয় কি না, সে বিষয়ে  চিন্তিত ছিলেন বলেও তিনি জানান। 

বর্তমানে তীব্র তাপপ্রবাহ বিবেচনা করে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে  শিক্ষক অভিভাবকসহ সকলকে স্বাগত জানাচ্ছে। পাশাপাশি সারা বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম দুপুর ২টার মধ্যে সমাপ্ত করে শিক্ষার্থীদের গোসল, গরম ভাত খাওয়া, বিশ্রাম বা ঘুমসহ বিকেল চারটায় খেলাধুলা বা বিনোদনের অধিকারসহ শিখন ঘাটতি দূর করার দাবি রইলো। শিশুর জন্য প্রয়োজন শিশু মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা ও সময়সূচি। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষাবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম হোক। এই প্রত্যাশা সবার।

লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৪০ দিনের মধ্যেই এইচএসসির ফল প্রকাশ - dainik shiksha ৪০ দিনের মধ্যেই এইচএসসির ফল প্রকাশ বন্যা: ৮ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৯ লাখ, নিহত ২ - dainik shiksha বন্যা: ৮ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৯ লাখ, নিহত ২ উপবৃত্তি দিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha উপবৃত্তি দিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য আহ্বান এমপিওর দাবিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের মানববন্ধন - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের মানববন্ধন দুর্নীতিবাজ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলির আল্টিমেটাম: মর্যাদা রক্ষা কমিটি - dainik shiksha দুর্নীতিবাজ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলির আল্টিমেটাম: মর্যাদা রক্ষা কমিটি বন্যা পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসায় চালু রয়েছে ৪৪৪টি মেডিক্যাল টিম - dainik shiksha বন্যা পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসায় চালু রয়েছে ৪৪৪টি মেডিক্যাল টিম একদিন ছুটি নিলেই মিলবে চার দিনের ছুটি - dainik shiksha একদিন ছুটি নিলেই মিলবে চার দিনের ছুটি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025079250335693