শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তির বিষয়ে আমাদের দেশের শিক্ষকেরা একটি ধারণা পোষণ করেন, শারীরিক শাস্তি দেয়া ছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা দেয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের মানুষ করতে হলে তাদের শারীরিকভাবে শাস্তি দিতেই হবে, তা নাহলে তারা মানুষ করা যাবে না, পড়াশোনা করানো যাবে না। আমাদের দেশের আগের যুগের শিক্ষকেরা ছিলেন নিবেদিনপ্রাণ। তাদের সততা, মেধা, বুদ্ধি ও নির্লোভ মনোভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতেন তারা। সেখানে অমনোযোগী কিংবা ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীদের কঠোর শাস্তিও দিতেন। এটি ওই যুগে মেনে নেয়া হতো। শিক্ষকদের সততা ও প্রকৃত ডেডিকেশনের কারণে, অভিভাবকেরাও কিছু বলতেন না। ওইসব শিক্ষক ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু শিক্ষা বিষয়ে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ ছিলো না। তারা নিজেরা যেটি ভালো মনে করতেন তাই করতেন। আর অভিভাবকেরাও মনে করতেন, সন্তানকে মানুষ করতে হলে গুরুর শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে। শারীরিক শাস্তি শিক্ষার্থীদের মননে ও মানসিকতায় যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে সেটি নিয়ে চিন্তা, গবেষণা কোনোটিই কিন্তু সে যুগে হতো না। যুগে যুগে সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে শিক্ষাদানে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে এবং শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণে।
বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে সে ধরনের ডেডিকেশন নেই, শিক্ষার্থীদের আচরণ গুরুভক্তির মতো অবস্থা সব জায়গাতে নেই। সবক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া ও পশ্চিমা হাওয়া। সবমিলে শিক্ষকতা আর আগের জায়গায় নেই। শিক্ষকদের কাজের ধরনও পাল্টে গেছে। শিক্ষকদের অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় আর শিক্ষার্থীরা আধুনিকতার ছোঁয়ায় আগের মতো শিক্ষকদের ভক্তি, শ্রদ্ধা হয়তো সবক্ষেত্রে করেন না। আবার পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে চান না। শিক্ষকেরা যেসব কাজ দিয়ে থাকেন তাও ঠিকমতো করে না। তাই, স্বভাবতই শিক্ষকদের মেজাজ একটু খারাপ হওয়ার কথা, কতোক্ষণ আর মেজাজ ঠিক রাখা যায়। তাই কেউ কেউ মনে করেন, শিক্ষার্থীদের বেত মারলে তারা সোজা হবে। আসলে এটি একটি ভুল ধারণা। তা ছাড়া শারীরিক শাস্তি দিলে শিক্ষার্থীরা যে একটু নমনীয় ভাব দেখায় সেটি একেবারেই সাময়িক। সেটির কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই। রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি নেকিবাচক প্রভাব। এতে আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তি বোঝায় যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তির উদ্দেশে শারীরিক বল প্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরনের শাস্তির অন্তর্ভূক্ত। বিশ্বে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে প্রায় চারটি বাড়িতে এক ধরনের সহিংসতার শিকার হয়, যা করা হয় শৃঙ্খলার নামে।
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও শিশুরা শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ অনেক জায়গায় শিশুদের শাস্তি দেয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী বাংলাদেশের এক থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিক্ষার হয়েছে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু অ্যান্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন’ ১৫০টির বেশি গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করে, শারীরিক শাস্তি শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া আরো কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণাও শাস্তির নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছে।
আমি ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেছি, সেখানে কোনো ম্যানহ্যান্ডলিং নেই। তবে রয়েছে, মিলিটারি কায়দায় বিভিন্ন ধরনের শাস্তি। যেমন-এক্সট্রা ড্রিল, ফ্রন্ট রোল, ফ্রগ জাম্প, ক্রোলিং ইত্যাদি। এগুলো শাস্তি হলেও এক ধরনের শারীরিক ব্যায়ামও বটে। তাই হয়তো বিষয়টিকে পুরো নেতিবাচক শাস্তি হিসেবে দেখা হয় না। তবে, সিনিয়র ক্যাডেটরা অনেক সময় জুনিয়রদের ওপর এগুলো একটু বেশি প্রয়োগ করে ফেলেন। কাজেই সেটিও সঠিক জায়গায় নেই। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমরা এখন অনেক কিছু দেখতে পাই। ফেসবুকে মাঝে মাঝে দেখি শিশু শিক্ষার্থীদের হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই, কিংবা সামান্য কারণে কিংবা শিক্ষার্থী জানেনই না তিনি কি করেছেন। অথচ কোনো কোনো শিক্ষক বেত, লাঠি, ডাস্টার ইত্যাদি দিয়ে বেদম প্রহার করে চলেছেন। কোনো শিক্ষক যখন এই কাজটি করছেন তখন কিন্তু তার আসলেই কোনো হুঁশ-জ্ঞান থাকে না। তিনি যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন তখন তারও অনুশোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই শিশুটির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যায়, সেটিকে স্বাভাবিক করার আর কোনো উপায় থাকে না। সৃষ্টি হয় শিক্ষালয়, শিক্ষাদান ও শিক্ষকের প্রতি এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক ধারণা যা আমরা শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে পারি না। মেনে নেয়া উচিত নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, বহু ত্যাগ, বহু কষ্টের বিনিময়ে শিক্ষকেরা তাদের পেশা চালিয়ে যান কিন্তু তারপরেও ভাবতে হবে এটি চোর-পুলিশ খেলা নয়। এটি হচ্ছে মহত্তম কাজ, তা সমাজ যেভাবেই দেখুক। তাই আমরা আমাদের শালীনতা বজায় রেখে, শিক্ষকতা পেশার প্রকৃত সম্মানের কথা ও দায়িত্বের কথা চিন্তা করে ভালোবাসা, পেশার প্রতি সততা আর নিষ্ঠার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চাই, শারীরিক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে নয়।
কিছু শিক্ষক কোনো গ্রহনযোগ্য সূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো এক গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রেণিকক্ষে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি পুরোপুরি বন্ধ করার কারণে সেখানে অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২ শতাংশ। আর শিক্ষকের সঙ্গে অসদ্ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে ৭২ শতাংশ। আবার অনেক দেশ যেসব দেশে বর্তমানে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি নেই সেসব দেশের অনেকেই পুনরায় শ্রেণিকক্ষে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি চালুর চিন্তাভাবনা করছে। শিক্ষক শারীরিক শাস্তি দিলে তাকে তিরস্কার করা হোক কিন্তু শারীরিকভাবে বেশি আঘাত করা যাবে না এবং শারীরিক শাস্তির একটা সীমা নির্ধারণ করা উচিত। এখানে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন দেশের সামাজিক কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই সাঠিক আচরণটি হয়তো করছেন না কিন্তু শারীরিক শাস্তির প্রচলন করে সেটিকে ঠিক করার ব্যবস্থা খুব একটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। অনেক দেশ বরং ধীরে ধীরে শারীরিক শাস্তি তুলে দিচ্ছে। শারীরিক শাস্তির সীমা নির্ধারণ করা মানে হচ্ছে এটিকে বৈধতা দেয়া। বড়রা যখন ছোটদের কিংবা শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেন করেন তখন এর পেছনে যে কারণগুলো কাজ করে সেগুলো হলো-বয়স্কদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের হতাশা, বয়স্কদের কোনো বিষয়ে জটিলতার সম্মুখীন হওয়া, অভ্যাসবশত হঠাৎ রেগে যাওয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। শিশুকে শাসনের নামে আঘাত করার বৈধতা দেয়া হলে সেটি যখন প্রয়োগ করা হবে তখন যিনি প্রয়োগ করছেন তার হুঁশ-জ্ঞান থাকে না, তিনি মেপে মেপে তা প্রয়োগ করতে পারেন না। বিষয়টি আসেই ইমোশন ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা থেকে। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ে এবং সমাজে যেসব অনাচারের মুখোমুখি হন সেই থেকে তারা অনেকে মনে করেন যে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি দিলে বোধহয় সমাজের এসব অনাচার অনেকটাই দূর হবে। বিষয়টি আসলে তা নয়। কোনো কিছু শেখানোর কৌশল হিসেবে শারীরিক শাস্তি কোনোভাবেই আসলে কার্যকরী পদ্ধতি নয়। কারণ, শাস্তি এড়ানোর জন্য শিশুরা হঠাৎ কোনো পরিবর্তিত আচরণ করেন, কিন্তু সংশোধিত হন না।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক