শিক্ষার্থীরা মাদকের অলীক বিভ্রমে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

অনেক সম্ভাবনা, বুক ভরা আশা আর হৃদয়ের গহিনে লালিত স্বপ্নকে সঙ্গী করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সর্বাত্মক প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। আগতদের অনেকে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসে। অনেকের কোনো আত্মীয়-স্বজনও ঢাকায় থাকে না। প্রথমবারের মতো নিরঙ্কুশ স্বাধীন জীবন পেয়ে যায় অনেকেই। এ স্বাধীনতা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে কেউ স্বপ্নকেও অতিক্রম করে যায়। আর কেউ স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে হারিয়ে যায় ব্যর্থতার অতল গহ্বরে। অনেকে জীবনের বিনিময়ে ভুলের মূল্য পরিশোধ করে। পরিবারকে ভাসিয়ে যায় অনিশ্চয়তা আর দুঃখের সাগরে। শিক্ষার্থীদের সাফল্যের গল্প আমাদের আনন্দ দেয়। কিন্তু ভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরার কাহিনিও নেহাত কম নয়। মাদক, অপরাজনীতি, প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা ইত্যাদি কারণে সম্ভাবনাময় জীবন অন্ধকারের চোরাগলিতে আটকে যায়। বৃহস্পতিবার (১০ জুন) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়,সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মী হাফিজুর রহমানের মৃত্যু সংবেদনশীল সবার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ ঘটনার পর পুলিশি তদন্তে নতুন মাদক এলএসডিসহ বিভিন্ন মাদকের বিস্তারের তথ্য উঠে এসেছে। ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা আমাদের আতঙ্কিত না করে পারে না। মর্মন্তুদ এ ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নড়েচড়ে বসেছে।

মাদকের নেশা নতুন নয়। যুগে যুগে মাদকের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট যুক্ত হয়েছে। তরুণ সমাজ মূলত সঙ্গদোষ, অজানার প্রতি আকর্ষণ ও সামাজিক কু-প্রভাবে মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এলএসডি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞ মতানুসারে এলএসডি মানব মস্তিস্কে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অলীক অনুভূতি তৈরি করে। দুঃখবোধ নিয়ে এলএসডি গ্রহণ করার পর দুঃখের অনুভূতি তীব্র করে। আনন্দের প্রাথমিক অনুভূতি নিয়ে গ্রহণ করার পর আনন্দের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। উভয় ক্ষেত্রেই চলক বাস্তব জগতের ঊর্ধ্বে চলে যায়। নিজের বোধ-বুদ্ধি আর বাস্তব চিন্তার অনুভূতি লোপ পায়। গাঁজা বা অন্য মাদকের গন্ধের কারণে অন্যরা টের পেলেও এলএসডি স্বাদ-গন্ধহীন হওয়ায় কেউ সেবন করলে কারও বোঝার উপায় থাকে না।

সামাজিক ও সেলফ সেন্সরবোধ বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অভিধান থেকে উধাও হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল শিক্ষক বা মুরুব্বিস্থানীয় কাউকে দেখলে তরুণরা অপ্রত্যাশিত কাজ থেকে দৌড়ে পালাত। বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র শিক্ষার্থীরা সিনিয়রদের অভিভাবকত্ব মানত। ইদানীং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে গাম্ভীর্যের পর্দা উঠে গেছে। সম্প্রতি লন্ডনে পিএইচডি গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের প্রতি গভীর অনুরাগে ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, 'টিএসসিতে কয়েকজন ছেলেমেয়ে প্রকাশ্যে ধূমপান করছিল। আমি নিষেধ করায় আমাকে বলেছিল, এই ক্যাম্পাস আপনার বাপের না।' আমি লজ্জায় দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের প্রক্টোরিয়াল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সম্মানহানির ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অপ্রত্যাশিত আচরণ দেখেও না দেখার ভান করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। আমাদের পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে সমাজ তার ভারসাম্য হারিয়েছে। আজকের দিনে মানুষের কাজ না থাকলেও ব্যস্ততার কমতি নেই। সব বয়সের মানুষ ফেসবুকের নেশায় বুঁদ। এখন সন্তানের একাকিত্ব পূরণ হয় বিভিন্ন ডিভাইসের সঙ্গে অলীক চিন্তাকে সঙ্গী করে। সুন্দরের স্বপ্ন দেখানোর আপনজনও আজ ব্যস্ত আপনারে লয়ে।

কয়েকদিন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টোরিয়াল টিম শাহবাগ থানা এবং ডিএমপি রমনা জোনের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। সেখানে যে চিত্র উঠে এসেছে তা খুবই হতাশাজনক। অরক্ষিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আলো-আঁধারি পরিবেশে ছোট ছোট গ্রুপে বসে অনেককে মাদক সেবনরত অবস্থায় পাওয়া যায়। অনেকে পরিস্থিতি টের পেয়ে মাদকদ্রব্য ফেলে দেয়। ড্রাগ ডিলারদের ক্যারিয়ার হিসেবে যারা কাজ করে তাদের শ্রেণিচরিত্র দেখে সন্দেহ করার অবকাশ থাকে না। মাদকসেবীদের অধিকাংশই সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। এই দলে মেয়েদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নির্জন পথে সল্ফ্ভ্রান্ত গোছের এক মেয়েকে নির্লিপ্তভাবে হেঁটে যেতে দেখা যায়। তিনি একটি ব্যাংকে চাকরি করেন বলে জানান। তাকে সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়। মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করেন এমন একজনের কাছে সেই মেয়ের আচরণ ও 'বডি ল্যাঙ্গুয়েজ' বর্ণনা করলে মেয়েটি এলএসডি সেবন করে থাকতে পারেন বলে তিনি জানান। প্রথমদিনের অভিযানে ছাড়া পাওয়া একজন মেয়েকে দ্বিতীয় দিনের অভিযানেও পাওয়া যায়, যিনি প্রথমদিন ভুল করে ঢুকে পড়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়া একদল তরুণের কাছে মাদক সেবনের বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা মাদক সেবনের বিষয়টি স্বীকার করে ভবিষ্যতে এ ভুল করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের চেহারা আর কথাবার্তায় ভারসাম্যহীনতার স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তাদের কয়েকজন রাজনৈতিক সংগঠনের বড় ভাইয়ের পরিচয় দিয়েছিল। পরে এই তরুণদের অভিভাবকদের ফোনে বিষয়টি অবগত করা হলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ওপর আস্থাশীল বলে জানান। সেই আস্থা আর অবাধ স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন করে নানাভাবে টাকা সংগ্রহ করে তারা মাদকের নেশায় জড়ায়। মাদকসেবী এই তরুণরা অনলাইনে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীও ছিলেন। গুরুতর নেশাগ্রস্ত কয়েকজনকে মাদকসহ থানায় সোপর্দ করা হয়েছিল। 

মাদকের নেশা অনেক সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীর জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন থেকে নিয়মিত অভিযান করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে অভিভাবকদের খোঁজ রাখা দরকার। নিরাপত্তা ও আলোবিহীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেন্দ্রিক মাদকচক্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। আলো সব সময়ই অন্ধকার দূর করে। এ উদ্যান আলোর উদ্যানে পরিণত হোক। মাদকের অভয়ারণ্য থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের বিনোদন কেন্দ্রে রূপান্তর করে ঐতিহাসিক এ উদ্যানের মর্যাদা রক্ষা করা দরকার। বাউন্ডারিবিহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। সন্দেহভাজন শিক্ষার্থীদের 'ডোপ টেস্টের' আইনি কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। মাদকের কারণে আমাদের আর কোনো শিক্ষার্থীর মূল্যবান জীবন যেন নষ্ট না হয় সে পদক্ষেপ নিতে সংশ্নিষ্ট সবাই এগিয়ে আসুক।

লেখক: মো. আবদুর রহিম, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ - dainik shiksha শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040638446807861