শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন নয়, বই তুলে দিন

আব্দুল্লাহ আল মামুন রনী, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

আফ্রিকার সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকা যার প্রবেশদ্বারে লেখা রয়েছে – ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরিক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরিক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত দালান-কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এ ছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি।’

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের দাড়প্রান্তে। এই অবস্থা সৃষ্টির একটা অন্যতম কারন শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন। প্রাথমিকে পড়া শিক্ষার্থীও স্মার্ট ফোনে পারদর্শী। এরাও ব্লগ, টিকটক, ভিডিও গেমস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় সদস্য। এরাও অনেকে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। আমার একছাত্র পড়াশোনা কিছু পারেনা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে সে ঠিকমতো বানান করে পড়তে পারতোনা। তারবাবা একদিন বললো- স্যার আমার ছেলেটাকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছি। ছেলে প্রযুক্তিতে খুব এক্সপার্ট। আমার ল্যাপটপের যেকোনো সমস্যা ও অনায়াসে ঠিক করে দেয়। আমি ভাবছি-ছেলেকে ফ্রিল্যান্সার বানাবো। কিছুদিন আগে শুনলাম -সেই ছেলেটা এখন অনেকটা অ্যাবনর্মাল। সারাদিন গেমস খেলে। স্কুল ছেড়ে দিয়েছে বেশ আগেই। সারারাত জেগে থাকে, সারাদিন ঘুমায়। সেই বাবা এসে বলতেছে- স্যার কিভাবে আসক্তি থেকে ফেরাবো? আমি বললাম - মোবাইল কে কিনে দিছে? বলল- আমি দিয়েছিলাম, তবে বাধ্য হয়ে।

২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর বন্ধ ঘোষণা করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রথমে ১০দিন, এরপর ২০দিন। কিন্তু দিনে দিনে পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করে। প্রায় ছয়মাস পর বিদ্যালয়ে সীমিত আকারে কার্যক্রম চালু হয়। মাঝের দিনগুলোতে যেমন স্বাস্থঝুঁকি, তেমন কড়াকড়ি। বাইরে বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঘরবন্দি শিক্ষক, শিক্ষার্থী- অভিভাবকসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ।

এসময় চালু হয় অনলাইন ক্লাস, অনলাইনে বাড়ির কাজ দেয়া। এভাবেই মোবাইল ব্যবহার শুরু। যাদের বাড়িতে স্মার্টফোন ছিলো না তারাও সন্তানের লেখাপড়ার সুবিধার্থে একটা স্মার্টফোন কিনে ফেলে। সময় কাটাতে আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন গেমস, অফলাইন গেমস, ব্লগ, ইউটিউব, সোস্যাল মিডিয়ায় ঝুকে পড়ে। আসক্ত হয়ে পড়ে স্মার্টফোনে।

করোনাভাইরাস এর টীকা আবিষ্কৃত হলে জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। বাংলাদেশ টীকার আওতায় আসে।পৃথিবী স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ততোদিনে স্মার্টফোনে আসক্তির মাত্রা চরমে। এরমধ্যেই চালু হয় নতুন কারিকুলাম। 

নতুন পাঠ্যবই এ তথ্যের অপ্রতুলতা, অজানা জিজ্ঞাসায় ভরপুর, নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রজেক্ট তৈরিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই দিশেহারা হয়ে ওঠে। তথ্য খুঁজতে শিক্ষক -শিক্ষার্থী সবাই অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠে। সবথেকে বড় ক্ষতি হয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, উত্তর ইউটিউব এ সহজপ্রাপ্যতা। শিক্ষার্থীর ধ্যান-ধারনা হয় সারাবছর কষ্ট করা মানে হয় না, পরীক্ষার নাম পরিবর্তন হয়ে নাম হয় মুল্যায়ন উৎসব। গাদাগাদি করে বসে একসঙ্গে একক কাজ, জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ফলে নিজে না জেনে দলের কেউ জানলেই হবে এমন ধারনায় শিক্ষার্থী পড়ালেখা প্রায় ছেড়ে দেয়। পরীক্ষায় নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা, নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলে পড়ালেখা যাদুঘরে যাওয়ার উপক্রম হয়।

মেধাক্রম না থাকা, ক্লাস রোলের প্রথা বিলুপ্তি ঘটা, ত্রিভুজ চতুর্ভুজের মাধ্যমে শিক্ষার্থী মুল্যায়ন করা হয়। নৈপুন্য অ্যাপস এর মাধ্যমে ফল প্রদান করা হলে কারও বোধগম্য হয়না এটা ভালো নাকি মন্দ ফলাফল? পাস-ফেল না থাকার ফলে শিক্ষার্থী বই ফেলে অনলাইন প্লাটফর্মে বেশি সময় দেয়।

শিক্ষার্থীদের প্রতি শ্রেণিতে স্টাডি গ্রুপ খুলে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট গ্রুপে সমমনা কিছু শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত কথা বার্তার জন্যে বাছাইকৃত কিছু সদস্য নিয়ে ভিন্ন গ্রুপে চ্যাটিং শুরু করে। এরপর সম্পর্ক ভিন্নদিকে মোড় নেয়ার অনেক ঘটনা হরহামেশাই চোখেপড়ে। অনলাইন গেমস প্ল্যাটফরমে ছোটবড় একসঙ্গে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন প্লাটফর্মে পজিটিভ কিছু করছেনা এমন না। কিন্তু নেগেটিভ ঘটনাগুলো ব্যথিত করছে। এই মুহূর্তে বিশেষ করে মাধ্যামিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে হয়তো আমাদের ভয়ানক পরিণতি ভোগ করতে হবে। একটা আশার বাণী হচ্ছে নতুন কারিকুলাম আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই বন্ধ হচ্ছে। আমি আশাবাদী মানুষ। স্বপ্ন দেখি নতুন এক বাংলাদেশের। যে দেশে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার থাকবে কিন্তু অপব্যবহার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষক (গণিত), খরসুতী চন্দ্রকিশোর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002708911895752