পুরোনো কিন্তু সব সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা হলো-শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তাই কোনো জাতিকে মেরুদণ্ড সোজা করে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার মাধ্যমেই একজন মানুষ সুশৃঙ্খল ব্যক্তি হিসাবে গড়ে ওঠে। উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর জনগোষ্ঠী শতভাগ শিক্ষিত। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু সবাই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে না বা যেতে পারছে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার পরও অনেককেই লেখাপড়ায় ধরে রাখা যাচ্ছে না। যতটুকু লেখাপড়া জানলে একজন মানুষকে শিক্ষিত বলা হয়, ততটুকু লেখাপড়াই সম্পন্ন করানো যাচ্ছে না। যখন হয়তো একজন বালক বা কিশোরের লেখাপড়া করার কথা, তখন তাকে জীবনসংগ্রামে নেমে পড়তে হচ্ছে। তাই দেশে প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায় থেকেই শিশুরা ঝরে পড়তে শুরু করে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রমকে নিরবচ্ছিন্ন রাখা তো সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। বৃহস্পতিবার ( ২ নভেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরো জানা যায়, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে বিদ্যালয় গমনোপযোগী প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হলেও ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ে বা পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার আগে আরও ৩৭ শতাংশ ঝরে পড়ে। ভালো মানের প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঝরে পড়ার হার কিছুটা কম হলেও ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে এ হার উদ্বেগজনক। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম শ্রেণিতে একশজন নিবন্ধিত হলেও সত্তরজনের বেশি পরীক্ষায় আসছে না। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার বলছেন, নবম শ্রেণিতে নিবন্ধনকৃতদের মধ্যে এসএসসিতে ফর্ম পূরণ না করা শিক্ষার্থীরাও ঝরে পড়ার আওতাভুক্ত।
কয়েক বছর আগে সেভ দ্য চিলড্রেনসহ শিশুদের নিয়ে কাজ করা ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থা রাজধানীতে শিশু অধিকার বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী এবং ৩৩ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের এ অব্যাহত ঝরে পড়ার পরিস্থিতি সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পথে বড় অন্তরায়। ২০২১ সালের শেষদিকে ওই একই প্রতিষ্ঠান তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মহামারির কারণে বিশ্বের ৯৭ লাখ শিশুর আর কোনোদিন হয়তো স্কুলে ফেরা হবে না। আসলে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এ শিশুরাই সবচেয়ে অধিকারবঞ্চিত হয়।
ঝরে পড়ার একাধিক কারণের মধ্যে অসচেতনতা, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, নদীভাঙন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা অন্যতম। দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে ঠেকেছে, যার প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত পরিবারগুলোয় মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একই কারণে অনেক পরিবার শিশুদের কায়িক পরিশ্রম করাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক বাবা-মা ভাবেন, সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে কী হবে, তার চেয়ে কাজ করে কিছু উপার্জন করুক। এই যে শিশুরা একবার স্কুল ত্যাগ করল, পরবর্তীকালে তাদের অনেকের স্কুলে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
মূলত শহরের বস্তি এলাকা, গ্রামের হতদরিদ্র, স্বল্প-আয়ের মানুষ এবং চর ও হাওড় অঞ্চলের শিশুরাই শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে করোনায় চাকরি হারানো ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিবারের সন্তানরা। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমনিতেই মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা ব্যয় অনেক বেশি। খাতা-কলম ছাড়াও এ স্তরে প্রাইভেট টিউশন, কোচিং ও অন্যান্য খরচও আছে। তাছাড়া জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যয়বৃদ্ধি সামাল দিতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। তাই পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে, ছেলেসন্তানকে ছোটখাটো কাজে ভিড়িয়ে এবং কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়ে বাড়তি খরচকে সমন্বয় করতে চেষ্টা করছেন। ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। শহরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার বেশি হলেও লেখাপড়ার বাইরে থাকা ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যেই খুব বেশি, যা রাজধানীতে শিশুশ্রমের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। তাদের আর্থিক অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। এসব কারণে ওই অঞ্চলগুলোয় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হারও বেশি। নানা সামাজিক কারণেও দেশে বহু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। আর্থিক অসচ্ছলতা ছাড়াও বিয়ের পর অনেক মেয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে যায় বা অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়।
সমাজের একেবারে নিঃস্ব ব্যক্তিটিও চান তার সন্তান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। বস্তুত অর্থাভাবে বহু শিক্ষার্থীর লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। তাই গরিব-অসহায় পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের আর্থিক সহযোগিতা ও কর্মের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ের এসব মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে না পারলে পরিবারের শিশুদের কাজে যাওয়ার বদলে স্কুলমুখী করাটা কঠিন হবে। খেটে খাওয়া ও স্বল্প-আয়ের মানুষের বসবাসের এলাকাগুলোয় মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বাবা-মা মনে করেন, মেয়ের বয়স যা-ই হোক, বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে হয়তো চিন্তামুক্ত থাকা যাবে। এতে করে অল্প বয়সে বিয়ের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়াও বাড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতির উত্তরণে বাবা-মায়ের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
পরীক্ষায় ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং সুধী মহলেরও বহু ধরনের ‘জিজ্ঞাসা’ আছে। অনেক শিক্ষার্থী তো এ পদ্ধতি বুঝে উঠতেই পারেনি, উপরন্তু মনস্ক শিক্ষার্থীদের কারও কারও মধ্যেও একধরনের ‘সৃজনশীল’ ভীতি কাজ করে। তাই ‘সৃজনশীল’ ভীতিও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়াকে ত্বরান্বিত করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। গণিত ও ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা ঝরে পড়ার হার বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। এ সমস্যা সমাধানে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করতে হবে, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান বাড়াতে হবে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা ক্লাসে লেখাপড়া বুঝতে না পারলে, শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি ভালো না লাগলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো সন্তান যখন বলবে সে স্কুলে যাবে না, তখন অভাব-অনটনের সংসারে বাবা-মা তাকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ওরা ক্লাসের পাঠ ঠিকভাবে বুঝতে পারছে কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিনামূল্যে পাঠ্যবই, শিক্ষা উপকরণ প্রদানের পাশাপাশি ঝরে পড়াপ্রবণ এলাকায় ও স্কুলগুলোয় ‘মিড ডে মিল’ ব্যবস্থা অবশ্যই চালু করতে হবে। বিনামূল্যে বই প্রদানসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও শিশুদের স্কুলে ধরে রাখতে না পারার বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। আমাদের শিশুরা বেশি বইয়ের চাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে লেখাপড়া তাদের কাছে নিরানন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্কুলে যেতে না হলেই মনে হয় তারা বাঁচে। উন্নত দেশগুলোয় নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের পড়ালেখা ক্লাসেই হয়ে যায়, কষ্ট করে তাদের বই বয়ে বেড়াতে হয় না। আমাদের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক খুব একটা সহজ-স্বাভাবিক নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক সম্পর্কে ঘাটতি আছে, ঝরে পড়ার হার সেখানে বেশি। এ সমস্যা গ্রামাঞ্চল ও শহরতলিতে বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সম্পর্ক জোরালো করার পাশাপাশি সেখানে আদর, ভালোবাসা, øেহ, মমতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব পক্ষকে নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের নিয়মিত আয়োজনের মাধ্যমে সম্পর্কের আড়ষ্টতা কাটতে পারে।
খেটে খাওয়া ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে জীবনমান উন্নয়নে ‘লেখাপড়া’কে লাগসই ও লোভনীয় বিষয় হিসাবে উপস্থাপন ও পরিবেশন করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ শিক্ষাকে ব্যাপক ও বিস্তৃত করতে হবে। সারা দেশে এসব প্রতিষ্ঠান এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যেন যে কোনো এলাকার মানুষ ঘরের খেয়েই সহজে জীবন গড়ার সুযোগ করে নিতে পারে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম থেকে দশম শ্রেণির যে কোনো পর্যায়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়াকে ঝরে পড়া বলা হচ্ছে। স্কুলজীবনের মোটামুটিভাবে দশ বছরের এ সময়টিতে একজন মানুষের জীবনের ‘বেসিক লেখাপড়া’ সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর এ লেখাপড়াটিই তাকে জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। তাই কেউ যদি এ সময় লেখাপড়া বাদ দিয়ে দেয়, তাহলে সে বেসিক লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ে যায়। তাই যেভাবেই হোক, এ ঝরে পড়া রোধ করতে হবে। আর এজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মনোযোগ’ ও ‘অগ্রাধিকার’-এর জায়গাটি আগে নির্ধারণ করতে হবে।
দেশে কদিন পরপর একেকটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, আর বছর বছর এমএ/বিএ ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আমরা হয়তো বুঝতে পারছি না এমএ/বিএ ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে শক্ত ‘বেসিক এডুকেশন’ সম্পন্নকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি দেশ, জাতি ও সমাজ উন্নয়নে বেশি প্রয়োজন।
লেখক : সালাহ্উদ্দিন নাগরী, সরকারি কর্মকর্তা, কলাম লেখক