মাধ্যমিক শিক্ষায় নিয়োগ, এমপিওভুক্তি, বদলি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে পদে পদে অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। 'মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শিক্ষাখাতের নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে কোন খাতে কতো ঘুষ দিতে হয় তার আনুমানিক একটা চিত্রও প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ও শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত অনুসন্ধানে আরো ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে যে খাতে যতো ঘুষ দিতে হতো, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইতে এসে সেগুলোর অধিকাংশেরই পরিমাণ বা মাত্রা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন শুরু হওয়ার পর শিক্ষাখাতের বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্যে বেশ ভাটা পড়েছে বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে পূর্ববর্তী তথ্যের তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হতো। এ টাকা যেতো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষা কর্মকর্তা ও পরিচালনা কমিটির পকেটে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইতে এই খাতে ঘুষের মাত্রা দাঁড়ায় ৫ লাখ থেকে ৩০ লাখে।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সুপারিশকৃত সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানে প্রধান শিক্ষক বা গভর্নিং বডি বা স্কুল কমিটিকে দিতে হতো ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। ২০২৪ এর জুলাইতে এ খাতে দিতে হয় ১ লাখ থেকে ৩ লাখ। সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হতো। যা কমে ৫০ হাজার থেকে এক লাখে নেমেছে। আগে এই নিয়োগের পুরোটাই ছিলো স্কুল ম্যানেজিং কমিটি পকেটে। এই নিয়োগের প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব এনটিআরসিএর হাতে যাওয়ায় ঘুষ কমেছে বলে অভিমত শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।
শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিতে হতো ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ পর্যন্ত। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার থেকে ২ লাখে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষার কাজে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের এক মাসের এমপিওর টাকা দিতে হতো অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দিতে হতো ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা। তিন বছরে ওই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ থেকে ১০ লাখে।
এ ছাড়া পাঠদান অনুমোদনের জন্য বোর্ড বা মন্ত্রণালয়ের মধ্যসত্ত্বভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হতো ১ থেকে ৫ লাখ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে যা বেড়ে ২ থেকে ১০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। স্বীকৃতি নবায়নের জন্য বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হতো ৫ থেকে ৩০ হাজার। যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ থেকে ৫০ হাজারে। আর শিক্ষক বদলীর ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২ থেকে ৪ লাখে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে এমপি বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির হস্তক্ষেপে সভাপতি মনোনীত করা হয়। এতে অনেকাংশে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সম্পৃক্ত হতে পারেন না, যা শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কমিটির সভাপতি- সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার শিথিলতা অনেক ক্ষেত্রে অশিক্ষিত লোক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। এতে সদস্যাদের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন সমস্যা ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
এসব নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ আদায়েও জড়িত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে থাকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও কলেজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।
টিআইবির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চারটি স্থানে 'হাদিয়া বা সম্মানী' দিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার অভিযোগ আছে। শিক্ষক ও কর্মচারীর এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া অনলাইনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রধান শিক্ষক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস বরাবর আবেদন করে থাকেন। পরবর্তীতে আবেদন গ্রহণ ও নথি যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে জেলা শিক্ষা অফিসে এবং জেলা শিক্ষা অফিস থেকে উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে এমপিওর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ এবং অনলাইন হওয়ার পরও শিক্ষক ও কর্মচারীর ভোগান্তি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি আগের মতোই বিদ্যমান।
টিআইবির ওই প্রতিবেদন আরো বলছে, অনেক ক্ষেত্রে এমপিও প্রক্রিয়ায় প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ কর্তৃক আবেদনকারী শিক্ষকের পরিদর্শন সঙ্গে চুক্তি এবং এমপিও আবেদন নিরীক্ষায় অগ্রায়নে 'শিক্ষা অফিসে এবং কমিটির অর্থ সুপারিশের জন্য অর্থ লাগবে' বলে প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক আবেদনকারী শিক্ষা শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা প্রতিবেদন আদায় করে থাকেন। টাকা না দিলে আবেদনে ত্রুটি ধরা, অগ্রায়ন না করা ইত্যাদি হেনস্তা করা হয়। নথিগত সমস্যার কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হয়। এছাড়া প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়ম-বহির্ভূত টাকার বিনিময়ে এমপিওভুক্তির অভিযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরিবিধিমালা অনুযায়ী তিন বছর পর পর বদলির বিধান থাকলেও তা নিয়মিত করা হয় না। তদবির ও নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের মাধ্যমে বদলি বা পছন্দনীয় স্থানে দীর্ঘদিন অবস্থানের অভিযোগ রয়েছে। পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতির অনুমোদন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এতে অনেক ক্ষেত্রে তদবির, নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায় এবং প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও সুপারিশে দূরত্ব সনদ ও জনসংখ্যার সনদ নেয়া এবং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে তদবিরের মাধ্যমে পাঠদান অনুমোদন নেয়া হয়।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষার অডিটর ম্যানেজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় জাল সনদ, নিয়োগে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাতসহ নানান অনিয়ম পাওয়া যায়। জানা যায়, অনিয়ম থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে কখনো কখনো প্রভাব খাটানো হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নথির বিভিন্ন দুর্বলতাকে ব্যবহার করে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ আদায়ে যেমন চাপ প্রয়োগ করা হয়, নথিপত্রের বিভিন্ন দুর্বলতায় পরিদর্শককে ম্যানেজ করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ দেয়া হয়। নিরীক্ষাকালে প্রতিষ্ঠানের সব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এক ও দুই মাসের এমপিও'র টাকা দাবি ও আদায় করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক 'পরিদর্শনে অডিটর আসছে' বলে শিক্ষকদের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং পরিদর্শককে ম্যানেজ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। কখনো কখনো এর একটি অংশ প্রতিষ্ঠান প্রধান আত্মসাৎ করেন। এছাড়া উপ- পরিচালকরা পরিদর্শনে যাওয়ার আগে অনেক ক্ষেত্রে টিমে না পাঠিয়ে একা পাঠানোর জন্য পরিচালক বরাবর তদবির করেন। পরিদর্শনে সংগৃহীত নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের বেশিরভাগ অংশ নিজের কাছে রাখার জন্য এই তদবির করা হয়। এক্ষেত্রে পরিচালককে নানা ধরনের উপঢৌকন দিয়ে ম্যানেজ করা হয়ে থাকে।
এছাড়া ২০১৭ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সরকারিকরণকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আত্তীকরণে বিলম্ব হয়, যে কারণে অনেক শিক্ষককে অবসরে যেতে হয় সরকারি সুবিধা ছাড়াই। আবার শিক্ষার্থীদের পূর্বের মতোই টিউশন ফি দিতে হচ্ছে। সরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ম- বহির্ভূত অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।