দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: শিক্ষার প্রকল্পে বেহাল দশা। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রকল্পের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে না। ‘অদক্ষ’ ব্যবস্থাপনা, ‘কর্মপরিকল্পনার অভাব’ ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সংস্থার মধ্যে ‘সমন্বয়হীনতার’ কারণে এই অর্থ ফেরত যাচ্ছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, চলতি অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীনে মোট ৫৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের কর্মকর্তারা কোনো টাকাই খরচ করতে পারছেন না (গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর)। এই সময়ে বাকি প্রকল্পগুলোর আর্থিক খরচের অগ্রগতিও মাত্র ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট ১৩ হাজার ১৯২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার মধ্যে প্রকল্প সহায়তা (বিদেশি ঋণ) প্রায় ৩৫১ কোটি টাকা। মোট বরাদ্দের মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। এটি বরাদ্দের ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বাকি অর্থবছর অর্থাৎ আরএডিপিতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকাই ব্যয় হচ্ছে না।
অথচ এই সময়ে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বাস্তবায়নে জাতীয় (সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের) গড় অগ্রগতি ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। জাতীয় গড় অগ্রগতির তুলনায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অগ্রগতি ‘তুলনামূলকভাবে অনেক কম’ বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
এডিপিতে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ ব্যয় না হওয়ায় আরএডিপিতে বরাদ্দ প্রায় অর্ধেক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি আরএডিপিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য মোট পাঁচ হাজার ৫২৯ কোটি ২২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমানে আরএডিপি (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। আরএডিপিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির চেষ্টা করতে প্রকল্প কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনায় গত ৩১ জানুয়ারি এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যাবিবরণী গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয়।
ওই সভায় মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. একেএম শফিউল আজম বলেন, ‘অর্থবছরের শুরুতে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণীত না হওয়ায় আরএডিপিতে অর্থ হ্রাসের প্রস্তাব করতে হয়েছে।’
শিক্ষার বিভিন্ন সংস্থাওয়ারি প্রকল্পের বাস্তবায়নে অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অগ্রগতি ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) ১৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাংলাদেশ স্কাউটের ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অগ্রগতি ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
শূন্য ব্যয় হওয়া ১৩টি প্রকল্পের মধ্যে ইইডির দুটি, ব্যানবেইসের একটি, বাংলাদেশ স্কাউটের একটি এবং ইউজিসির ৯টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ‘সন্তোষজনক’ পর্যায়ে উন্নীতকরণের জন্য প্রকল্প পরিচালকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে।
এ বিষয়ে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘ইইডির কোনো প্রকল্পে শূন্য অগ্রগতি নেই। মাউশির প্রকল্পে এটি হতে পারে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘ফান্ড রিলিজ, করোনা মহামারী, ফান্ড ব্যয়ের ত্রৈমাসিক পরিকল্পনা প্রণয়নসহ আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ ছিলো।’
তারা সেসব ‘চ্যালেঞ্জ’ (প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যা) কাটিয়ে উঠছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা নিয়মিত সভা করছি; মন্ত্রনালয় থেকেও নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি দুই মাসের মধ্যে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৪০ শতাংশের বেশি হবে।’ ৫ বছরের প্রকল্প ৮ বছরে অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ
‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (২য় পর্যায়)’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৭-২০১৮ এবং ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ইন হাউজ প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য ১৫ দিনের ওয়ার্কশপের মাধ্যমে ৫টি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রণয়ন করা হয়। এই ম্যানুয়ালের মাধ্যমে ২০১৭-২০১৮, ২০১৮-২০১৯ এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মোট এক লাখ ৪৭ হাজার ৯১৩ জন শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হয়েছে।
নতুন কারিকুলামের সাথে সমন্বয় সাধনের জন্য প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালসমূহ রিভিউ ও আপগ্রেড করার জন্য ১৫ দিনের ওয়ার্কশপ আয়োজন করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে একটি ওয়ার্কশপ আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই খাতে ১৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় ধরা হয়েছে বলে প্রকল্প অফিস থেকে জানা গেছে। অথচ এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্যই ছিলো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা।
আইসিটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। প্রায় সাড়ে ১৩শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৩৪০টি হাই স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু আট বছরে একটি প্রতিষ্ঠানেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন হয়নি। বারবার দুর্নীতির কবলে পরেছে প্রকল্পটি। অথচ প্রায় দেড় লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে এ পর্যন্ত ১১৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এ মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।
এই প্রকল্পের নতুন দায়িত্ব পাওয়া প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক সাহেদুল কবির বলেন, ‘প্রকল্পটির সকল কার্যক্রম প্রায় নতুনভাবে শুরু করতে হচ্ছে। প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প এবং বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতায় প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।’
ঢাকার সন্নিকটে ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্প
‘ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। গত সাড়ে সাত বছরে এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।
প্রকল্প পরিচালক মীর জাহিদা নাজনীন মাউশির এক সভায় বলেন, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ভূমি উন্নয়ন ও নির্মাণকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। চলতি মাসের মধ্যে ৬টি জমির (৬টি স্কুল প্রতিষ্ঠার স্থান) উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হবে এবং আগামী এপ্রিলে একটি জমির ‘সয়েল টেস্ট’ সম্পন্ন হবে। এ খাতে ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
মাউশি থেকে জানা গেছে, এই প্রকল্পটি প্রত্যাশিত গতিতে এগুচ্ছে না। কর্মকর্তারা ভূমি উন্নয়ন কাজ ঠিকমত না করেই আসবাবপত্র কেনাকাটায় বেশি জোর দিচ্ছেন। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার চেষ্টাও চলছে। আবার বিশেষ মহলের ‘স্বার্থ রক্ষায়’ সাইট সিলেকশনেও একাধিকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। এডিপিতে এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ‘শূন্য’ বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
অর্থছাড় নেই আট মাস পোস্ট গ্রাজুয়েট প্রকল্পে
মাউশির এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজসমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের (২য় সংশোধনী)’ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। অথচ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের আট মাস হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এর ফলে আর্থিক অগ্রগতি একেবারে ‘শূন্য’।
ইইডি জানিয়েছে, মাঠ পর্যায়ের ঠিকাদাররা চলমান কৃত কাজের পাওনা বিল না পাওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের চলমান কাজসমূহ শতভাগ সম্পন্ন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় প্রকল্প পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করা যাচ্ছে না এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে ইইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পোস্ট গ্রাজুয়েট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক নাসির উদ্দিনের বরাত দিয়ে গত ২৫ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পের বিপরীতে ১২৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা উপযোজনের জন্য কার্যক্রম বিভাগে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনও কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। অর্থ প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত করতে সমস্যা হবে।’
মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইইডির এক নির্বাহী প্রকৌশলীর গাফিলতির কারণে থমকে গিয়েছিল ‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এর পর শীর্ষ প্রকৌশলীর হস্তক্ষেপে প্রকল্পের কার্যক্রম গতিশীল হয়।
এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনী অনুমোদনে একটু দেরি হওয়ায় ৮১টি ভবনের নির্মাণকাজ আটকে ছিল। এটি অনুমোদন হওয়ার পর আমি নিজে হস্তক্ষেপ করে সম্প্রতি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্তত ৭০টি ভবনের দরপত্র আহ্বান করিয়েছি। এখন দ্রুত কাজ হবে।’
এদিকে টাঙ্গাইলের দুইজন ঠিকাদার জানিয়েছেন, কাজ পেলেও ‘ড্রয়িং-ডিজাইনের’ জন্য ইইডি প্রধান কার্যালয়ে অন্তত তিন মাস দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। তবে ‘সমঝোতা’ হলে দ্রুত ড্রয়িং-ডিজাইন মেলে। ঠিকাদাররা ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছতা’ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন।