শিক্ষার বাতিঘরের বিদায়

নাজমুল হোসেন |

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছিল জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের ৮৩তম জন্মদিন। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং ট্রাস্টি তারিক হাসান শমী ভাইয়ের কল্যাণে স্যারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গুলশানের বাসায় গিয়েছিলাম। সচারাচর রাত এগারটায় স্যার ঘুমাতে যান। কিন্তু আমার পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। তার ততক্ষণে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে নিজের শোবার ঘরে। সাড়ে ১১টায় স্যার অতিথি আগমণের খবর পেয়ে আবার পাঞ্জাবি পড়ে ড্রয়িংরুমে এলেন। আমাদের সাথে গল্প করলেন। এরপর আবার ঘুমাতে গেলেন।

আমার বিস্ময়ের যেন ঘোর কাটছিলেই না। এত বড় মনের মানুষ আনিসুজ্জামান স্যার। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের জন্য তাঁর বিনয় দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। আমার সারা জীবনের মূল্যবান স্মৃতি হয়ে থাকবে একজন জাতীয় অধ্যাপকের এমন আন্তরিক হৃদ্যতায়।

স্যারের সাথে এটিই আমার শেষ দেখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি শিক্ষক হিসেবে অনেকেই চিনলেই স্যার ছিলেন সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বামপন্থী-ডানপন্থী সবার কাছে তাঁর মাপকাঠি ছিল আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যোদ্ধা। ছাত্রজীবন থেকেই মৃত্যু অবধি তিনি বাঙালি পরিচয়ে নিজেকে লালন করে গেছেন। ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক সরকার যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি করে বাঙালিদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করতে চেয়েছিলেন তখন বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ড. আনিসুজ্জামানের মতো ব্যক্তিত্ব। “পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও” ব্যানারে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান। 

বক্তব্য রাখছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছবি কৃতজ্ঞতা : জার্নি

মননে মানসে বাঙালির মুক্তির দিশারী ছিলেন শিক্ষক আনিসুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি জনমত গঠনে কাজ করেছেন। সক্রিয় ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ড. আনিসুজ্জামান। তাঁর উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্র সংগীত চালুর পক্ষে বিবৃতি প্রদান করলে সরকারের টনক নড়ে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর আনিসুজ্জামান ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াত করতেন। নতুন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেয়া এবং স্বাধিকার আন্দোলনের উদ্ধুদ্ধ করতে তিনি ছিলেন অগ্রসেনানী।

একাত্তরের উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ড. আনিসুজ্জামান চট্টগ্রামে সক্রিয়ভাবে বাঙালির আন্দোলনে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৩১ মার্চ তিনি পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কলকাতায় গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে বাঙালির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একইসাথে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন অকুতোভয় শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান। অথচ তাঁর অনেক সহকর্মিই তখন পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি চালিয়ে গিয়েছেন। মুক্তির চেতনায় বিভোর আনিসুজ্জামান সফল হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বহুকাঙ্ক্ষিত সংবিধানের বাংলা অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
 
কখনই মাথানত করেননি অন্যায়ের কাছে। সবল মেরুদণ্ডের বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিলিয়ে গিয়েছেন জ্ঞানের আলো। ক্ষমতার মোহ কখনই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। বিনয় ছিল তাঁর সম্পদ। গবেষণা ছিল ধ্যানজ্ঞান। তাইতো মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন তিনি। কখনও অবসরের চিন্তা করেননি।

ছবি কৃতজ্ঞতা : জার্নি

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘একুশে পদক’ প্রাপ্তির পর ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে অর্জন করেন ভারতের তৃতীয় বেসামরিক পদক ‘পদ্মভূষণ’। এরপর ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে দেয়া হয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’।

করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় টালমাটাল গোটা বিশ্ব। এমন সময়ে আমরা অকস্মাৎ হারালাম বরেণ্য জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে। কয়েকদিন আগেই হারালাম আরেক জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে। করোনার ধাক্কা যখন চারদিকে শুধু দুঃসংবাদের ছড়াছড়ি এরইমধ্যে আনিসুজ্জামান স্যারের বিদায় এই বাঙালি জাতির জন্য বড় ধাক্কা। 

স্যার ওপারে ভালো থাকবেন। আপনি ছিলেন বাংলাদেশের জ্ঞানের বাতিঘর। 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032620429992676