শিক্ষার মানের সঙ্গে কোনো আপস নয়

মাছুম বিল্লাহ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিইয়ে রাখা কিছু সমস্যা দূরীকরণ। তবে, প্রায় দুই লাখের মতো শিক্ষার্থী এবং এক হাজার ২০০ শিক্ষকের মতামত যাচাই করা হয়নি অধিভুক্তির সময়ে। এ কাজটি প্রায় সব জায়গায়ই করা হয় না। ফলে, অনেক মহৎ কাজও সাফল্যের মুখ দেখে না। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তারা তাদের নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেন অধীনস্থদের ওপর কিন্তু যারা সরাসরি কাজের সঙ্গে, বিষয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের মতামত, পরামর্শ খুবই প্রয়োজন। এই কাজটি সাধারণত এড়িয়ে যাওয়া হয়। মহত উদ্দেশে করা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির পর শিক্ষার্থীদের সমস্যা তো কমেনি, বরং বেড়েছে। চার বছরের অনার্স শেষ করতে ছয় বছর এমনকি সাত বছরও লেগেছে। আমরা জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আবাসনসহ নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে যুগ যুগ পার করছে, সেখানে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সমস্যা কীভাবে দূর করবে? 

বিষয়গুলো নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরু হাসান মামুন স্যার একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঢাকার বড় বড় সাতটি কলেজ এবং আরো কিছু কলেজ নিয়ে নেপালের ত্রিভুবন বা পশ্চিমবাংলার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি ‘কলেজিয়েট ইউনিভার্সিটি’তে রূপান্তর করা যেতে পারে। কলেজিয়েট ইউনিভার্সিটি আসলে কী? কলেজিয়েট ইউনিভার্সিটি হলো এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কাজগুলো একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন অনুমোদিত কলেজগুলোর মধ্যে ভাগ করা থাকে। তিনি আরো লেখেন, এই সাত কলেজের আরো কয়েকটি কলেজ নিয়ে এর একটিকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ভবন হিসেবে বানিয়ে বাকি কলেজগুলোকে এর অনুমোদিত কলেজে পরিণত করা। কলেজগুলোতে কেবল ৩ বা ৪ বছরের অনার্স পড়ানো হবে। সেখানে থাকবে না উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি পাস কোর্স। 

এই অনুমোদিত কলেজে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মতো। পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের এখানে শিক্ষকতায় অগ্রাধিকার দেয়া হবে। যেখানে এই অনুমোদিত কলেজের শিক্ষকদের সবারও ন্যূনতম পিএইচডি থাকা উচিত। চার বছরের অনার্সই হবে টার্মিনাল ডিগ্রি। এরপর পুনরায় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে লিমিটেড সিটের জন্য ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মাস্টার্সে ভর্তি হতে হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কেবল সাত কলেজের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ক্যাম্পাসেই মাস্টার্স পড়ানো হবে। ৭০০-৮০০ কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর অনুমোদন দেয়া ছিলো একটা ক্রাইম। এসব কলেজে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক অথচ সেখানে থাকে উচ্চ মাধ্যমিক, বিএ ডিগ্রি পাসকোর্স এবং অনার্স-মাস্টার্স। অধিকাংশ কলেজেই ৪ থেক ৫ জন শিক্ষক আছেন। ফলে তারা চাইলেও অনার্স-মাস্টার্সের ক্লাস নিতে পারেন না। মাস্টার্স একটি বিশেষায়িত ডিগ্রি, যা সবার জন্য নয়। মাস্টার্স পড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক দরকার যাদের পিএইচডি আছে ও একই সঙ্গে গবেষণায় অ্যাক্টিভ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও সীমিত সংখ্যক যেমন ৫০টি কলেজে অনার্স পড়ানোর অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। বাকি কলেজের একটি বড় অংশে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস থাকতে পারে। একইসঙ্গে কিছু এক্সক্লুসিভ কলেজ হবে যেখানে কেবল এইচএসসি পড়ানো হবে। এই কলেজগুলো হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিডার কলেজ। 

এখানে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। একটি হচ্ছে, মাস্টার্স সবার করার দরকার নেই। কথাটি একদিকে সত্য। যেমন-হাজার হাজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের যদি বেকার থাকতে হয়, তাহলে সেই ডিগ্রি দেয়ার মানে কতোটা আছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আবার এটিও ঠিক, উচ্চশিক্ষা কেউ নিতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া ঠিক নয়। উচ্চশিক্ষার পথ সংকোচন করা যাবে না। এখানে বিষয়টি হচ্ছে, আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যে মাস্টার্সের সার্টিফিকেট দিচ্ছে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। এসব ক্ষেত্রে ক্লাস করার, কোনো বিষয় ভালোভাবে বোঝা বা না বোঝার তোয়াক্কা না করা। কিছু নোট মুখস্থ করে, বুঝে না বুঝে কিছু লিখে এলেই মাস্টার্স ডিগ্রিধারী হয়ে যাওয়া। এই বিষয়টি হতে দেয়া যায় না। সেই জন্যই এ ধরনের প্রস্তাব যে, ইচ্ছে করলেই কিংবা সবাই যাচ্ছে তাইভাবে মাস্টার্স ডিগ্রি নেবে, সেটি ঠিক নয়। এতে মাস্টার্স ডিগ্রির অবনমন করা হয়। তবে, যারা মাস্টার্স করতে আগ্রহী তাদের একটি রিগোরাস প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, কাঠখড় পুড়িয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে হবে। যারা নিয়মিত ক্লাস করতে পারবেন না, চাকরি বা ব্যবসা করেন তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা যেমন-নাইট ক্লাস, অনলাইন ইত্যাদির মাধ্যমে মাস্টার্স করার সুযোগ থাকতে পারে। তবে, সেটিও যেনতেন প্রকারে নয়। কারণ, শিক্ষার মান অবনমন করা বা করায় সহায়তা করা এক ধরনের অপরাধ। সেটি করার অধিকার আমাদের নেই। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলেজে ৪/৫ জন শিক্ষক দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি পাস ও অনার্স কোর্সে পড়ানো হয়, যার ফলে কোনটিই হয় না। আর এসব শিক্ষকের মধ্যে সবাই মাস্টার্সে পড়ানোর উপযোগী শিক্ষক নন। জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, উপজাতি কোটা, নারী কোটা ইত্যাদির মাধ্যমে বিসিএস এডুকেশনে ঢুকে পড়েছেন অনেক অনুপযুক্ত শিক্ষক। তারপরে তাদের নেই লেখাপড়া করে, পবালিকেশন্স করে প্রমোশন পাওয়ার সিস্টেম। এই পরিস্থিতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি দেয়ার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ। সেই কথাই এখানে বোঝানো হয়েছে।

শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, এখানে শুধুমাত্র সাতটি কলেজকেই কলেজিয়েট ইউনিভার্সিট করা যুক্তিযুক্ত হবে। নতুন করে কোনো কলেজকে যুক্ত করা ঠিক হবে না। কারণ, দীর্ঘ আট বছর যাবৎ ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে। যার ফলে সাতটি কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা কলেজকে প্রশাসনিক কেন্দ্র করে বাকি ছয়টি কলেজকে কলেজিয়েট করলে সেটি সবার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। আবার কিছু শিক্ষক বলছেন, কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয় করলে নতুন করে আবার কিছু ঝামেলা সৃষ্টি হবে। সেশন জট হতে পারে। তা ছাড়া সাতটি কলেজের আলাদা ঐতিহ্য আছে সেটি আর থাকবে না। আবার এতে করে সার্টিফিকেটের মানও কমে যাবে। আসলে কি তাই? সাত কলেজকে কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা গেলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষান মান উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংকট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে বলে কিছু শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়ায় কমেন্ট করেছেন। এই সাতটি কলেজ নিয়ে যা করা হবে সেটি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। তবে, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেটি কাম্য নয়। শিক্ষার মানের সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করা ঠিক নয়।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের - dainik shiksha আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল লটারি পদ্ধতি রেখে হাইস্কুলে ভর্তি নীতিমালা প্রকাশ - dainik shiksha ডিজিটাল লটারি পদ্ধতি রেখে হাইস্কুলে ভর্তি নীতিমালা প্রকাশ প্রাথমিক শিক্ষকদের গেজেট সংশোধনের দাবি - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষকদের গেজেট সংশোধনের দাবি মফস্বলের স্কুল-কলেজে যে হারে বেতন ও বার্ষিক ফি - dainik shiksha মফস্বলের স্কুল-কলেজে যে হারে বেতন ও বার্ষিক ফি সাত কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের দুই বিষয়ের ফল প্রকাশ - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের দুই বিষয়ের ফল প্রকাশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ফিল ইন মার্কেটিংয়ের ফল প্রকাশ - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ফিল ইন মার্কেটিংয়ের ফল প্রকাশ বুটেক্স শিক্ষক পরিচয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ - dainik shiksha বুটেক্স শিক্ষক পরিচয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057311058044434