এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ৬ মে রোববার। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেল, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবারের ফল খারাপ হয়েছে। এও জানা গেল, এই খারাপ ফলের মূল কারণ ইংরেজি ও গণিতে বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে এবার আরও দেখা গেল, পাসের হার কমেছে; তবে বেড়েছে জিপিএ ৫ প্রাপ্তি। এ ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে, জিপিএ ৫ প্রাপ্তি কিংবা পাসের হারের ঊর্ধ্বগতি শিক্ষার মানের বিষয়টি নিশ্চিত করে না। খতিয়ে দেখা দরকার, শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে। পাসের হার বেড়েছে নাকি কমেছে, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। মূল বিবেচ্য হলো শিক্ষার মানের বিষয়টি। অনস্বীকার্য যে, বিশ্বায়নের এই যুগে সবক্ষেত্রেই ইংরেজিতে দক্ষতার বিষয়টি জরুরি। এখনকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি-ভীতি রয়েছে। গণিতের ক্ষেত্রেও অবস্থা একই। বিগত কয়েক বছর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিখনমান কেমন তা যাচাইয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। ওই জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়।
এই অভিযোগ অমূলক নয় যে, ইংরেজি ও গণিত সহজবোধ্য করে পড়ানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ঘাটতি রয়েছে যথাযথ প্রশিক্ষণেরও। অধিকাংশ শিক্ষক পাঠদান করান ভালো নম্বর প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে, যথাযথভাবে শেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। শিক্ষার্থীদের কাছে ইংরেজি ও গণিত সহজবোধ্য করে পাঠদান ও শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ নতুন নয়। আমরা যদি মানসম্পন্ন পাঠদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে শিক্ষায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার পথটি মসৃণ করব কীভাবে? শিক্ষার মান বাড়াতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। একই সঙ্গে শিক্ষার পরিবেশও নিশ্চিত করা দরকার। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেই বলা যাবে না যে, শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে। তবে অনস্বীকার্য যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখানেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে হবে না। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা একটি প্রক্রিয়া কিংবা পদ্ধতির মধ্য দিয়েই করা সম্ভব। আরও একটি জরুরি বিষয় হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের নিরসন ঘটাতে হবে। আমরা যদি শিক্ষার সামগ্রিক চিত্র পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, শহরের সঙ্গে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ব্যবধান রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যবধান বাড়ছে। শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে আনতে না পারলে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার অবকাশ থাকবে না। ইংরেজি ও গণিতের দক্ষ শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রেই নেই; তবে গ্রামের ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও প্রকট। শিক্ষার্থীদের জীবনে মাধ্যমিক স্তরের ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ স্তর অতিক্রম করে তবেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর পরিসরে প্রবেশের সুযোগ পায়। এই সুযোগ ভবিষ্যৎ গঠন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। মূলত শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর হলো ভিত মজবুত করার উপযুক্ত সময়। গোড়ায় গলদ রাখলে চলবে না। এবারের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের অস্বস্তিকর অভিযোগের মধ্য দিয়ে। এই পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, এটি ধারণা করা যায়।
শিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়ে এ পর্যন্ত সচেতন মহল থেকে অনেক কথাই বলা হয়েছে। সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে আন্তরিক নয় কিংবা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেনি, এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু তারপরও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। এই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিগত ও বর্তমান সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সুফলও পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দু'ভাগে ভাগ করে শিক্ষার ভিতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগটি বিভিন্ন মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করে উপস্থাপনের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, এর ইতিবাচক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু তাই বলে যে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সব সমস্যা দূর হয়ে গেছে, তা নয়। এখনও বেশ কিছু সমস্যা বিদ্যমান এবং এসবের নিরসনে অত্যন্ত দ্রুত সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য।
তারপর আসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু নেতিবাচকতার কথা এখনও শোনা যায়। এর মধ্যে শিক্ষকসহ অবকাঠামোগত সংকটের বিষয়টি গুরুত্ববহ। আগেই বলেছি, মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে দক্ষ-প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এই দুই স্তরের পাসের হার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে, তা অসত্য নয়। কিন্তু কতটা মানসম্পন্ন হয়েছে এ দুই স্তরের শিক্ষা তা নিয়ে কথা ওঠাটা অমূলক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল করেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য পরীক্ষায় বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী সফল হতে পারছে না। এ অবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের বিষয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আবারও বলি, গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু এ পরিবর্তন সব ক্ষেত্রে সমভাবে ঘটেছে কি-না এটিও একটি প্রশ্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন মানে তো সামগ্রিক পরিবর্তন নয়।
এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক উচ্চশিক্ষার দিকে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা কতটা এগিয়েছি এবং মান কতটা উন্নত করা সম্ভব হয়েছে, তাও প্রশ্নের বিষয়। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে এ পর্যন্ত কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসার দেশে উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়েছে, তা অসত্য নয়; কিন্তু কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে মাঝে ব্যাপক গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছিল। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড- এটি বহুল প্রচলিত একটি বাক্য। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে শিক্ষা খাতে দুর্নীতির ব্যাপক ডালপালা ছড়িয়ে ছিল এবং এ নিয়ে রীতিমতো বাণিজ্য শুরু হয়েছিল- এমন অভিযোগ যথেষ্ট পুষ্ট। অতীতের তুলনায় অনেকটাই তা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এ ব্যাপারে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ দায়িত্বশীল সব মহলকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব, শিল্প-প্রযুক্তি, স্থানান্তর, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পরিবেশগত ভূমিকা সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে হবে। রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার বিষয়েও ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে গবেষণার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে গবেষণার জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু আছে। আমাদের দেশেও তা আছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কতটা যথেষ্ট, এ নিয়ে বিস্তর কথা আছে। শিক্ষা গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। গভীর পড়াশোনা, অনুধাবন, গবেষণা, গবেষণাভিত্তিক জার্নাল প্রকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান এবং যে সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রত্যাশা করা হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার দায়িত্বশীলদের। কারিগরি কিংবা প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিষয়টিও এখন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা কম ঘটেনি। এর পেছনে যেসব দুর্বৃত্ত কলকাঠি নাড়ে, সেই মূল হোতাদের খুঁজে বের করা জরুরি। আমাদের দেশে এখনও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। বেকারত্ব জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তির আশায়, বিশেষ করে একটি সরকারি চাকরির প্রলোভন সবারই থাকে। সরকারি চাকরি নামের সেই সোনার হরিণ শিক্ষিত বেকার যারা তারা সবাই ধরতে চান। যোগ্যতার মাপকাঠিতে প্রত্যাশিত চাকরি হয়তো সবার জোটে না; কিন্তু তারপরও একটি সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা সবাই পেতে চান। ইতিমধ্যে যারা এ চাকরির প্রলোভনে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন, তারা কোনো কিছু না জেনেই একটি নিশ্চিত জীবনের জন্য বক্রপথে পা রেখেছিলেন। সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্র তাদের জীবন চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। এমন দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে অনেক। এ দুষ্টচক্র শিক্ষাক্ষেত্রেও ছোবল বসাচ্ছে। এই শত্রুদের মূলোৎপাটনে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এ শত্রুদের শেকড়-বাকড় যে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন এমন কোনো ঘটনা আর না ঘটে, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। আস্থার সংকটের ছায়া যাতে বিস্তৃত না হয়, এ জন্যও সজাগ থাকতে হবে।
আস্থা সংকট, আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস এসবের নেপথ্যের একটি মাত্র কারণ বোধহয় সামাজিক অবক্ষয়। এ অবস্থা থেকে ফিরতে না পারলে আস্থার সংকট থেকে মুক্তি নেই। এ সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সামাজিক মূল্যবোধগুলো নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে সংকট দেখা দিয়েছে তা নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষা মানের নিম্নগতি ঘটবে এবং তা রোধ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন করে পরিকল্পনার ভিত্তিতে সুদূরপ্রসারী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা যাতে কোনোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, সে জন্য সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবশ্যই নিষ্ঠ হতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে দেশ ও জাতির অগ্রগতির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জাতির অগ্রগতি-উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অন্যান্য খাতের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়ে দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে।
শিক্ষাবিদ
সূত্র: সমকাল