শিক্ষার মান বাড়াতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সাম্প্রতিক সময়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশ পড়তে পারে। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাত্র ১৮ শতাংশের গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অবস্থা আরো খারাপ। প্রতিবেদনে ইউনিসেফ বলেছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং আবার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়তে ও গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতার ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। সোমবার (৪ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, গত এক বছরে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পার্থক্যের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের মাত্র ২৯ শতাংশের পড়তে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে, যেখানে স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে এই হার ৩৯ শতাংশ।

আমাদের দেশে দরিদ্র শিশুরা কোনো রকম বর্ণ পরিচয়, সংখ্যা পরিচয় ব্যতিরেকেই স্কুলে আসতে শুরু করে। দরিদ্র ও নিরক্ষর পরিবারের সন্তানরা প্রতিযোগিতায় উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তানদের তুলনায় পিছিয়ে থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসা শুরু করে। তাদের এগিয়ে নিতে চাইলে তাদের পুরো শিক্ষাটা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্কুলেই দিতে হবে, নইলে শিক্ষাব্যবস্থার শুরুতেই ধনী-দরিদ্র এবং স্বাক্ষর-নিরক্ষর শ্রেণির অভিভাবকদের সন্তানের মধ্যে এক বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাবে।

যেহেতু আমাদের প্রাথমিক স্তরে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র ও নিরক্ষর পরিবারের, তাই এদের পিছিয়ে রেখে দিনবদলের বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সেই লক্ষ্যে সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও মানবিক গুণসম্পন্ন একজন মানুষ গড়ার মূল ভিত্তিই হলো তার প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। আমাদের সমৃদ্ধির লাল-সবুজ প্রত্যয়ে আমরা খুঁজে পেতে চাই এক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সর্বজনীন বাংলাদেশকে। যে দেশে কেউ বেকার থাকবে না; কেউ শিক্ষাবঞ্চিত বা নিরক্ষর থাকবে না; সবাই হবে শিক্ষিত ও আলোকিত।

বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বীকৃত পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি শিক্ষা। শিক্ষিত মানুষ উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিক্ষিত জাতি দারিদ্র্য বিমোচনে উন্নয়নের আলোকবর্তিকা। দেশের ২০ কোটি মানুষকে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি উদ্যোগে দিন দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩৪ হাজার। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৭৫ লাখ, যার মধ্যে ছাত্রীর হার ৫০.৭৫ শতাংশ। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক এবং মেয়েদের ভেতর লেখাপড়ার আগ্রহ তুলনামূলক বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি লক্ষ করেছি প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। মাধ্যমিকেও এ হার খুব কম নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ে ‘শিখন সংকট’  (Problem of learning)

অত্যন্ত প্রকট। সংখ্যায় ও গুণগত মানে উপযুক্ত শিক্ষক গ্রামের স্কুলগুলোতে খুবই কম, শহরের স্কুলগুলোতে এর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও দরিদ্র শ্রেণির অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের প্রাইভেট পড়াতে বা গৃহশিক্ষকের আনুকূল্য লাভে সক্ষম হন না। পক্ষান্তরে শিক্ষিত ও সচ্ছল পিতা-মাতা নিজেরাও পড়াশোনার ব্যাপারে তাঁদের নিজ সন্তানদের সহায়তা দিতে পারেন। শিক্ষকদের একটি বড় অংশ প্রাইভেট পড়াতে বেশি উৎসাহী হওয়ায় শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। শিক্ষার মান হ্রাস পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেও অনেকে যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছেন না। তাঁদের অযোগ্যতা ফুটে ওঠে প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে। গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতায় তাঁরা অনেকেই সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে অক্ষম। গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও অঙ্কের উপযুক্ত ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই; ফলে দুটি বিষয়ে অপ্রতুল জ্ঞান নিয়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন তাঁরা পরবর্তী সময়ে সুবিধা করতে পারছেন না। বস্তুত এই দুর্বলতা নিয়েই প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার পথে যাত্রা করছেন। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিক্ষকদের জ্ঞানের দুর্বলতা ও উপযুক্ত শিক্ষকসংখ্যার স্বল্পতা। ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষক অবিলম্বে নিয়োগ দিতে চাইলে শিক্ষকতার পেশাকে মূল্যায়িত করতে হবে; তা না হলে মাধ্যমিকে ভালো ফলধারীরা এ পেশায় এগিয়ে আসবেন না। মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা যদি আকর্ষণীয় করে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তবেই এ পেশায় যোগ্যতাসম্পন্নরা এগিয়ে আসবেন।

সরকার এরই মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। আগামী বছর প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হচ্ছে! ২০২৩ সাল থেকে দেশের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলামের পাইলটিং শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি থেকে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২৪ সালে নবম ও দশম শ্রেণিতে আর আর্টস, কমার্স, সায়েন্স বিভাগ থাকবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে বিশাল আকারের বিনিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হবে। জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, মূল্যবোধ ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির উত্কর্ষ সাধনই হবে মূল লক্ষ্য। জাতির জনক বলে গেছেন, মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তাঁর যোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাই শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার দ্বার সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এখন বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পারলেই কেবল লক্ষ্য পূরণে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। ধনী-গরিবের সন্তানের জন্য আলাদা পাঠ্যক্রম, আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা নয়, একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের দাবি। তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে সেটিই হবে বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। আমাদের প্রত্যাশা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা শতাংশের হিসাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৮১ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

শিক্ষাব্যবস্থা আজ বহুলাংশে ডিজিটাল হয়েছে। এটি আমাদের একটা বড় অর্জন। করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তবু শিক্ষা কার্যক্রম একেবারে বন্ধ থাকেনি। ভার্চুয়ালি জুমের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেছে, পরীক্ষা দিয়েছে; কিন্তু গ্রামাঞ্চলে আন্তর্জালিক শিক্ষা প্রসারের সুযোগ এখনো সীমিত। তবু আমরা আশাবাদী শত প্রতিকূলতা দূর করে আলো আসবেই। গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত জাতিই হবে সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর জাতি। মানুষ তখনই সব কিছু অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারবে, যখন সে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ হবে। সেই মানুষই হবে সভ্যতার সারথি, জাতির সম্পদ। সেই লক্ষ্যে শিক্ষার মানোন্নয়নে আমাদের যেতে হবে আরো বহু দূর। শুধু শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, শিক্ষার মান বাড়াতে এবং সব দৈন্য ঠেকাতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

 

লেখক : বাপ্পু সিদ্দিকী, সাবেক প্রধান শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0076289176940918