শিক্ষায় অযোগ্য নীতিনির্ধারক এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

যে-কোনো বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব অপরিমেয়। অযোগ্য অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং অপরিপক্ব ব্যক্তিদের হাতে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব থাকলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি বিশ্বসমাজের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে যোগ্য ব্যক্তি এ দায়িত্বে থাকলে কাক্সিক্ষত ফল লাভ করা সহজ হয়, সংশ্লিষ্ট কারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বুধবার (২১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জাানা যায়,  আমার নাতনির দুর্ভোগের কথা বলছি। ২০১৭-১৮ সালে সে যখন সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত আমি তাকে বলতাম, নোট-গাইড থেকে প্রশ্নোত্তর মুখস্থ না করে পাঠ্যবই বুঝে পড়, শেখা হলে লিখে ফেল, লেখা শেষে ভুলগুলো চিহ্নিত করে পুনরায় শেখ। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় চিঠি লেখ, যে-কোনো চেনাজানা বস্তুর বর্ণনা লেখ, পাঠ্যপুস্তকে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর নোট-গাইড থেকে মুখস্থ না করে বই পড়ে নিজেই উত্তর লেখ, ভুল হলে সংশোধন কর। গণিতের সমস্যা পড়, কী উল্লেখ আছে আর কী জানতে চাওয়া হচ্ছে চিন্তা করে বের কর। এরপর যুক্তি প্রয়োগে সমাধান করতে চেষ্টা কর। এভাবে ভাষার দক্ষতা এবং গণিতের ভিত মজবুত হবে, অন্যসব বিষয় পড়ে বুঝতে পারবে এবং প্রশ্ন যেমনই হোক উত্তর দিতে পারবে। এভাবে শিখলে প্রথম প্রথম পরীক্ষার ফল খুব ভালো না-ও হতে পারে কিন্তু এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকলে ভবিষ্যতে উচ্চতর শ্রেণিতে ভালো ফল পাবে। দাদার পরামর্শ মেনে নাতনি আমার পড়ালেখা চালাতে থাকল।

২০১৯ সালে জেএসসি পরীক্ষা দিল। আহামরি ফল না করলেও আমার আশানুরূপ ফল করছে। ১১টি বিষয়ের মধ্যে ৪টি A+, ৪টি A, ২টি A- এবং ১টি B পেয়েছে। পরিবারের অন্য কেউ সন্তুষ্ট না হলেও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, যেহেতু ভিত তৈরি করতে পেরেছে বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষা সুদৃঢ় হবে। ভবিষ্যতে অবশ্যই ফল ভালো হবে। যা ভেবেছিল তা-ই হলো, ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে ৭টি বিষয়ে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত। ৭টি বিষয়েই নাতনি A+ পেয়েছে, এর মধ্যে ৫টি বিষয়ে শতকরা ৯০-এর ওপরে নম্বর পেয়েছে। এখন পরিতাপের বিষয় হলো, এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ৭ বিষয়ে, সে A+ পেয়েছে পরীক্ষা নেওয়া ৭টি বিষয়েই। কিন্তু তার জিপিএ ৫.০০ না হয়ে হয়েছে ৪.৮৯। কারণ বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে এসএসসি পরীক্ষা না হলেও এ তিনটি বিষয়ে জেএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেড এসএসসির ফলাফল হিসেবে দেখানো হয়েছে। শুধু দেখানোই হয়নি, জেএসসি ও এসএসসির প্রাপ্ত গ্রেড একত্র করে এসএসসির চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।

২৮ নভেম্বর প্রকাশিত নাতনির এসএসসি ফলাফল দেখে আমি মর্মাহত, ক্ষুব্ধ এবং বিচলিত। আমার বুঝে আসছে না কোন বিবেচনায় জেএসসি ও এসএসসির ফল একত্র করে এসএসসির ফল নির্ধারণ করা হলো। এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আইনের আশ্রয় নিলে এ সিদ্ধান্ত টিকবে বলে মনে হয় না। এটা তিন বছরের অনার্স নামক এক পর্যায়ের শিক্ষা নয় যে, প্রতি বছরান্তে গৃহীত পরীক্ষার ফল একত্র করে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা যায়। জেএসসি ও এসএসসি দুই স্তরের (নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষা কার্যক্রম। তা ছাড়া

জেএসসি ও এসএসসির পাঠ্যসূচিও একই মানের নয়। জেএসসি থেকে এসএসসির পাঠ্যসূচির কাঠিন্যের মাত্রা উচ্চতর এবং পরিসর বেশি। তা ছাড়া জেএসসির প্রাপ্ত গ্রেড এসএসসির গ্রেডের সঙ্গে একত্র করে এসএসসির গ্রেড নির্ধারণ করা হবে, এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে জানানো হয়নি। চার বছর আগে তারা অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার আগেই জানানো আইনসংগত হতো। শিক্ষার্থীরা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারত। এ প্রসঙ্গে Piaget-এর Theory of Cognitive Development উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন দেশ থেকে নেওয়া বড় নমুনাভিত্তিক গবেষণার ফলে বিভিন্ন বয়সের অবধারণ ক্ষমতা বা সামর্থ্যরে তারতম্য তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অবধারণ ক্ষমতা আর দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এ ক্ষমতা সমমানের নয়। কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের ফল সুদূরপ্রসারী। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ) ভর্তি পরীক্ষায় ভর্তি প্রার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের আনুপাতিক অংশ বিবেচনায় নিয়ে ভর্তি প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে যারা জেএসসি পরীক্ষায় আলোচ্য তিনটি বিষয় ভালো করেনি তারা এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া ৭টি বিষয় এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেও ভর্তির সুযোগ না-ও পেতে পারে।

আমার নাতনির কান্না থামানো যাচ্ছে না। দাদার পরামর্শে মুখস্থ না করে শক্ত ভিত গড়তে গিয়ে জেএসসিতে আশানুরূপ ফল লাভ করেনি। এসএসসিতে পরীক্ষা নেওয়া সব কটি বিষয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েও সার্বিক ফল জিপিএ ৫-এর পরিবর্তে ৪.৮৯। এ ফল তার উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ ভেবে নাতনি বলে ‘আমি আর পড়ালেখা করব না’। তাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব! সে তো পরীক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৭টি বিষয় তার সক্ষমতার পূর্ণ স্বাক্ষর রেখেছে। এ অবস্থা শুধু আমার নাতনির একা নয়, দেশের শত শত নাতি-নাতনির। কেবল উল্লিখিত সিদ্ধান্তই নয়, নীতিনির্ধারক কর্তৃক শিক্ষা ক্ষেত্রে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব জাতিকে অনেক দিন ভোগ করতে হবে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অটোপ্রমোশন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, কম নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া ইত্যাদি।

লেখক : অধ্যাপক (অব.) আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের - dainik shiksha গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস - dainik shiksha শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম - dainik shiksha মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে অধ্যাপকদের অনলাইনে বদলির আবেদন শুরু ১ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha অধ্যাপকদের অনলাইনে বদলির আবেদন শুরু ১ সেপ্টেম্বর সব মাদরাসায় ওয়েবসাইট হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসায় ওয়েবসাইট হালনাগাদের নির্দেশ ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত শিক্ষাঙ্গনের ভদ্রতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাঙ্গনের ভদ্রতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025660991668701