শিক্ষায় আইসিটি ও শিক্ষকদের আর্তনাদ

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |
Mujammel Ali
অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী

আজ আমরা প্রযুক্তির যুগে বসবাস করি। বিজ্ঞানের যুগ পেরিয়ে এখন আমরা প্রযুক্তির যুগে। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার মানব সভ্যতায় ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। এতোদিন পৃথিবী ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বলে গণ্য হলেও ইদানিং অনেকে আমাদের পৃথিবীটাকে ‘গ্লোবাল ফ্যামিলি’ ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন।

প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যের কারণে মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতার কাছে সব কিছু আজ পরাভূত। তাই আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি আজ একান্তই মানুষের। মানুষ গোটা পৃথিবীকে নিজের বশে এনেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায়।

গত শতকে মানব জাতির সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অচিন্ত্যনীয় সাফল্য। মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির উদ্ভাবন মানব সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে ভিন্ন এক উচ্চতায়।

আমাদের বাংলাদেশ এ থেকে পিছিয়ে নেই। প্রযুক্তির নানান ব্যবহারে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যপানে। তথ্যের অবাধ আদান প্রদান সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্ব শর্ত। তথ্য ও প্রযুক্তির নিত্য ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদের শিক্ষায় এর সফল সংযোজন ঘটিয়েছে। আমাদের শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শিক্ষাকে টেকসই ও মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিতে সহায়তা করছে। কম্পিউটারের মাধ্যমে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীর তথ্য সংরক্ষণ, শ্রেণি কক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে পাঠ উপস্থাপন ইত্যাদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক ও যুগোপযোগী পরিবর্তন আনয়ন করেছে।

বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। তারা এ লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষায় ‘কম্পিউটার’ শিক্ষা বিষয়টি সংযোজন করে। নিঃসন্দেহে এটি এক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। প্রথম পর্যায়ে মাধ্যমিক স্তরের নবম ও দশম এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বিষয়টি চতুর্থ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এর গুরুত্ব আরো বেশী উপলব্ধি করে বিষয়টির নাম পরিবর্তন করে ‘আইসিটি'(ICT) বা ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ রাখা হয় এবং তা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় স্তরের প্রতিটি শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিষয়টি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পঠিত হচ্ছে। শুনা যাচ্ছে, বিষয়টি নাকি প্রাথমিক স্তরে ও বাধ্যতামূলক করা হবে।

এক কথায়, সারা পৃথিবী যখন প্রযুক্তির কব্জায় চলে যাচ্ছে, তখন এ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় কোথায়? আমাদের সরকার সে কাজটি করে গোটা দেশবাসীর তো বটে, বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু, ঠিক যখন চারদিকে আইসিটি শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, ঠিক তখন আমাদের দেশে আইসিটি শিক্ষকের পদটি সৃষ্ঠপদ গণ্য করে তাদের এমপিওভুক্তি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ কেমন সিদ্ধান্ত? নিঃসন্দেহে এটি আত্মঘাতী এবং শিক্ষার পরিপন্থি।

আইসিটি অবশ্যই এক অতি জটিল বিষয়। বিষয়টিতে হাতে কলমে শেখবার অনেক কিছু আছে। সুতরাং, এ বিষয়টি শিক্ষা দেবার জন্য একজন করে নয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কম করে দু’জন করে আইসিটি শিক্ষক থাকা বাঞ্চনীয় ছিল। কেননা, আমাদের প্রতিটি শ্রেণিতে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ শিক্ষার্থীকে এবং এভাবে পাঁচ পাঁচটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একজন শিক্ষক কী করে আইসিটি শিক্ষা দেবেন? কিন্তু, দু’জন দূরে থাক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিধি মোতাবেক নিয়োগদানকৃত মাত্র একজন করে আইসিটি শিক্ষকের এমপিও প্রদানের পথটি আমরা রুদ্ধ করে রেখেছি।Class Room-2

দেশে কয়েক হাজার আইসিটি শিক্ষক তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন- সেটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে দূর্ভাগ্যজনক। শিক্ষায় আইসিটি’র ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও ডিজিটাল বা মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম তৈরির ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু সে সবের সফল বাস্তবায়ন যারা করবেন, তাদের প্রতি প্রথমে থেকেই নজর দেয়া আমাদের সবার উচিত ছিল।

বিগত ১৩ নভেম্বর, ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে কেবল শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির পথ রুদ্ধ করা হয়নি, জাতিকে ঘোর অমানিশার অন্ধকারে ঠেলে দেবার একটা হীন ও সূক্ষ্ম চক্রান্ত লক্ষ্য করা যায়। কেননা, আইসিটি শিক্ষাকে বাদ দিয়ে কিংবা অবহেলা করে আজ আর কোন জাতির এগিয়ে যাবার সুযোগ নেই।

বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার ম্যারাথন দৌড়ে আমাদের জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে একমাত্র আইসিটি শিক্ষা। আর আইসিটি শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তুলে ‘ভিশন-২০২১’ বাস্তবায়নে আইসিটি তথা কম্পিউটার শিক্ষকরাই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন।

আমাদের দেশে সকল শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত থাক, সৃষ্টপদের সকল শিক্ষকসহ আইসিটি শিক্ষকদের দূর্ভোগের অবসান হোক- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। প্রযুক্তির সর্ব সাফল্যের যুগে আইসিটি শিক্ষকদের আর্তনাদে প্রযুক্তির ভিত্ কেঁপে উঠুক- এ আমরা চাই না। ১৩-১১-২০১১ তারিখের কালো ও ঘৃণ্য পরিপত্রটি অবিলম্বে উঠিয়ে নিয়ে আইসিটি শিক্ষার পথ প্রসারিত করার জন্য শিক্ষা বান্ধব সরকার সমীপে নিবেদন।

মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023009777069092