শিক্ষায় বাজেট কী বৈষম্য-ঘাটতি মেটাবে?

মাছুম বিল্লাহ |

আওয়ামী লীগ সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বাদশ সংসদের প্রথম বাজেট ঘোষণা করলো। এবার শিক্ষায় প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ থাকছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাজেটের আকারের সঙ্গে বরাদ্দ বাড়লেও ইউনেসকোর হিসেবে এখনো জিডিপির ৪ শতাংশে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল বহরের বাজেট শিক্ষার উন্নয়নে কতোটা ভূমিকা রাখবে তা আমরা সঠিক করে বলতে পারছি না। তবে, এটি ঠিক সরকারের বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয় এবং অপচয়ও হয়। তার মধ্যে আবার বিভিন্ন সেক্টরকে প্রায়োরাটাইজ করতে হয়। সেই প্রায়োরাটাইজেশনে শিক্ষা কখনই বাস্তাবিক অর্থে ওপরের মানদণ্ডে পৌঁছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক স্যাম্পল ভাইটাল স্টাটিসটিকস ২০২৩ জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের শিশু ও তরুণদের ৪১ শতাংশ, মানে প্রায় আড়াই কোটি কোনো শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে ছিলেন না। এই হার ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ছিলো ২৯ শতাংশ।

শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী কমে গেছে ১০ লাখ। শিক্ষার বাইরে থাকা শিশু তরুণদের সংখ্যা বৃদ্ধির আরো বিচার-বিশ্লেষণ দরকার। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষার বড় ক্ষতি করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০২১ ও ২০২২ এর অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগের অভাব এবং এর কার্যকারিতার সমস্যায় শিক্ষায় আগে থেকে বিদ্যমান বৈষম্য ও ফল অর্জনের ঘাটতি আরো বেড়েছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এই ক্ষতির ভার বেশি বহন করতে হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরে অন্তত তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট কোচিংয়ে যোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া ৯২ শতাংশের বেশি বাজারের গাইড বই ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে শিক্ষা বাজারের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে।

শিশু কতোখানি শিক্ষার সুযোগ পান, তা নির্ভর করে তার পরিবার কতো ব্যয় করতে পারে তার ওপর। এটি ৫০ বছর অতিক্রম করা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কোনো অর্থেই সুখবর নয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে যে শিক্ষার্থী ছিলো ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তাদের যথাক্রমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে ছিলেন না। এই ঝরে পড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সমগ্র ঝরে পড়ার হারের অতিরিক্ত। দেখা গেছে, পরিবারের জন্য প্রতি শিশুর বার্ষিক শিক্ষার ব্যয় ২০২২ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক স্তরে ২৫ শতাংশ আর মাধ্যমিকে বেড়েছে ৫১ শতাংশ। তার মানে হচ্ছে, পারিবারিক শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলেছে।

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ব্যয়ও পুরোটা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গেছে, শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করছে পরিবারগুলো। এটা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বেশি। ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে নেপালে ৫০ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ ব্যয় বহন করে পরিবারগুলো।

ভালো শিক্ষাদানের জন্য ভালো শিক্ষক প্রয়োজন। আর ভালো শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রয়োজন উচ্চমাত্রার প্রণোদনা। না হলে শিক্ষায় মেধাবীরা কেনো আসবেন? বিষয়টি আগে প্রণোদনা দিয়েই শুরু করতে হবে। এখন যেসব শিক্ষক শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন তাদের সবাই হয়তো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মানে নেই, কিন্তু তাই বলে তাদের বেতন বাড়ানো হবে না, অথচ তাদেরকে সেই ফিনল্যান্ড আর ইংল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বের শিক্ষকদের মানের সঙ্গে তুলনা করা হবে সেটাও ঠিক নয়। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২২টি মন্তণালয়ের সঙ্গে জড়িত, তাই বাজেট সে রকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই না।

ঝরে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিতদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপের মধ্যে শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফিরিয়ে এনে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি এবং বঞ্চিতদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন। বিবাহিত মেয়ে শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পাঠদানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়াদের উন্নয়ন করা দরকার। শিক্ষকদের অতিরিক্ত কাজের বোঝা কমিয়ে যথার্থ দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, কাজের স্বীকৃতি ও সম্মানি দেয়া, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ ও মাধ্যমিকে সরকারি সাহায্যে স্বল্প ব্যয়ে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা। এগুলো শিক্ষায় অবশ্যম্ভাবী বিষয়, যা কোনো বাজেটে চমৎকারভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।

শিক্ষায় আমাদের জিডিপি ধারাবাহিকভাবে কমছে। যেখানে আন্তর্জাতিক মান হচ্ছে জিডিপির ৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ থাকা। আমরা সেখানে ক্রমাগতভাবে কমাতে কমাতে গত বাজেটে সেটি করেছি ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ আর জাতীয় মোট বাজেটের ১২ শতাংশেরও নিচে। এসবের প্রভাব আমরা বিভিন্নভাবে দেখতে পাই।

নতুন শিক্ষাক্রমে দক্ষ শিক্ষক অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে এখন আর মেধাবীরা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকতায় আসতে চান না। কারণ, যেকোনো পেশায়ই অর্থিক নিশ্চয়তা গুরুত্বপূর্ণ। যখন আর্থিক সক্ষমতা থাকে না তখন সমাজেও সম্মানজনক অবস্থান থাকে না। বেকার থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতায় আগ্রহ হারাচ্ছেন আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা, আমাদের তরুণরা। সদ্য প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় যে বরাদ্দ তা এসব সমস্যা সমাধানে কতোটা সহায়ক হবে?   

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতে এ সহিংসতা: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha দেশকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতে এ সহিংসতা: প্রধানমন্ত্রী দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে : আরেফিন সিদ্দিক - dainik shiksha দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে : আরেফিন সিদ্দিক এইচএসসির উত্তরপত্র জমা নিচ্ছে না বোর্ড - dainik shiksha এইচএসসির উত্তরপত্র জমা নিচ্ছে না বোর্ড কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় এতো ফেল! - dainik shiksha কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় এতো ফেল! বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে: ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ - dainik shiksha বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে: ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ - dainik shiksha ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038049221038818