রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় রূপকল্প-২০৪১ এর লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষার মানোন্নয়ন। আর এজন্য শিক্ষায় বড় বিনিয়োগ দরকার বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার বরাদ্দ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের পেছনে বেশি ব্যয় করতে পারছেন, তারা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে। আর যেসব অভিভাবক ব্যয় করতে পারছেন না, তাদের সন্তানরা মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছেন না। এতে শিক্ষায় বৈষম্য আরও বাড়ছে। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
আবার বিনিয়োগের অভাবে আমরা দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছি না। আমাদের দেশের অনেক মানুষ বিদেশে কাজের জন্য গেলেও তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকায় তাদের কম বেতনে কাজ করতে হচ্ছে। এতে আমাদের অনেক মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও সেই তুলনায় রেমিট্যান্স আসছে না।
দেশের এই বাস্তবতায় আজ মঙ্গলবার সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৩’। ইউনেস্কো এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘জনগণের জন্য বিনিয়োগে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিন’। তবে দিবসটি আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় না। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু সভা-সেমিনারের মাধ্যমেই দিবসটির আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে আমাদের দেশে শিক্ষায় বরাদ্দ মোট বাজেটের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর ২০২০-২১ শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে ইউনেস্কো সর্বশেষ শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। তবে একবারে এই বরাদ্দ ২০ শতাংশ দেওয়া সম্ভব না হলে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলেছিলেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০১০ এর সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দেশ বলেন, ‘শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ালে কী রিটার্ন আসতে পারে সে ব্যাপারে হয়তো কেউ সরকারকে বোঝাতে পারছি না। আমাদের অনেক মানুষ বিদেশে কাজ করছে। আমরা কি সেই তুলনায় রেমিট্যান্স পাচ্ছি? এজন্য অবশ্যই শিক্ষায় আমাদের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যাতে দক্ষ হিসেবে গড়ে ওঠে সে কাজে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। এজন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। কিন্তু সেটা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না।’
গত রবিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ কমলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বাড়ে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। শিক্ষা সব দেশের উন্নয়নের চাবি। ভোকেশনাল, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২-এ বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বাংলাদেশে মাধ্যমিকে ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার বহন করে। তবে এনজিও স্কুলে ফি সরকারির তুলনায় তিনগুণ ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ফি সরকারির তুলনায় ৯গুণ বেশি। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের বেশি রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাইভেট পাঠদান শিক্ষার্থীদের ভালো ফল পেতে সাহায্য করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে শিক্ষকদের অবদানই মুখ্য। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্য মেধাবীদের শিক্ষা খাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান এত নিম্নমানের যে, অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার সুযোগ থাকলে কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যারা আসেন তাদের কারোরই সাধারণত প্রথম পছন্দ শিক্ষা ক্যাডার থাকে না।
আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তারা তাদের চাকরির শুরুতে সর্বসাকুল্যে ১৭ হাজার টাকা বেতন পান। যদি আমাদের দেশের একজন মানুষের গড় আয় বিবেচনা করা যায় তাহলে প্রাথমিকের শিক্ষকরা তার চেয়েও কম বেতন পান। আর দেশের বেশিরভাগ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা বেসরকারি। তবে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সরকার এসব শিক্ষকদের শুধুমাত্র মূল বেতন দেয়। মূল বেতন হিসাব করলেও বেশিরভাগ শিক্ষকের শুরুর বেতনই প্রাথমিক শিক্ষকের কাছাকাছি।
অথচ উন্নত দেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয় অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত। আমাদের প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান আমাদের দেশের থেকেও অনেক উন্নত। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি গত ১২ বছরেও। এমনকি সরকারের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেই।
এছাড়া কভিডকালীন দেশের শিক্ষা খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শিক্ষায় ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরসহ নানা ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মুখে মুখে কারিগরি শিক্ষার কথা বলা হলেও সেখানে নেই বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ। আর এজন্যই শিক্ষায় বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন। পদ্মা সেতু বা মেট্রো রেলের মতো শিক্ষায়ও বড় প্রকল্প নিতে হবে এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।