শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ ও কিছু কথা

বাহালুল মজনুন চুন্নু |

একটা ভুল হয়েছে বলে সারা জীবন সেই ভুল করে যেতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি? নেই। ভুল শোধরানোটাই যৌক্তিক। কোনো বিশেষ কারণে কিংবা প্রেক্ষাপটে ভুলটি হয়ে গেছে, তাই বলে সেই ভুল যদি না শোধরানো হয়, তবে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, ধ্বংস অনিবার্য। এমন বড় এক ভুল হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে। ভুলটি হলো জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তি করার ভুল। এই ভুলটিতে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা লাভবান হলেও বিসিএস ক্যাডারদের প্রকৃত মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। একজন বিসিএস ক্যাডার হতে হলে কত ঘাম ঝরাতে হয়, কত নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়, কত ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হয়, কতগুলো বছর নিজেকে লেখাপড়ায় নিমগ্ন রাখতে হয় তা আমরা সবাই কমবেশি অবগত। কলেজ জাতীয়করণসূত্রে যদি মুড়িমুড়কির মতো ক্যাডারভুক্ত করা হয় তবে তা বিসিএস ক্যাডারদের প্রতি ভীষণরকম অন্যায়ই করা হয়; মেধা-ত্যাগ-তিতিক্ষা-পরিশ্রম-ধৈর্য এসব নীতিকথার প্রতিও অন্যায় করা হয়। এই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের নন-ক্যাডার রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কুমন্ত্রণায় দুরভিসন্ধিমূলকভাবে যে বিধি তৈরি করা হচ্ছে তাতে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে যারপরনাই হতবাক হয়ে গেছি।

বর্তমান সরকার দেশের প্রান্তিক মানুষদের সরকারি সুবিধায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ নেই সেসব উপজেলায় কলেজ জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ এক মহতী উদ্যোগ। কিন্তু এ উদ্যোগের একমাত্র সমস্যা জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করার সুযোগ দান। এ কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্যাডার পদগুলোর প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটি করা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও শর্তাবলি পূরণসাপেক্ষে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে একজন নাগরিক বিসিএস ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইবা, মেডিকেল টেস্ট, পুলিশ ভেরিফিকেশন, ইউএনও ভেরিফিকেশন, এনএসআই ভেরিফিকেশনসহ আরও নানান ঝামেলা মিটিয়ে তিন বছরের অধিককাল ক্ষেপণের পর বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হয়। অনেকে ভাইবা পাস করে, এতসব ধাপ পেরিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নন-ক্যাডার হতে সমর্থ হন। সব নন-ক্যাডারের কপালে আবার চাকরিও জোটে না।

এ অবস্থায় জাতীয়করণের দোহাই দিয়ে যদি বিসিএসের এমন কঠিন বৈতরণী পার না হয়ে গণহারে ক্যাডারভুক্ত হন বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা, তবে তাতে কেবল বিসিএস ক্যাডারদেরই বঞ্চিত করা হবে না, বিসিএসের মাধ্যমে নন-ক্যাডারপ্রাপ্তদেরও অবমূল্যায়ন করা হবে। জাতীয়করণকৃত কলেজশিক্ষকরা ভাগ্যের জোরে যদি বিসিএস ক্যাডার মর্যাদা পান তবে অন্য বেসরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকদের প্রতিও কি বঞ্চনা করা হচ্ছে না? বৈষম্য করা হচ্ছে না? তাদের ভাগ্যের শিকেয় জাতীয়করণ নেই এটাই কি তাদের দোষ? এতে আমাদের সিস্টেমের গলদটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা পুরো জাতির জন্যই হতাশার, বেদনার। বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে অনেক শিক্ষকই আছেন ক্লাসে খুবই ভালো পড়ান, অনেকের অনেক রকম যোগ্যতা আছে। তাই তাদের যাবতীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক, এটা প্রত্যাশা করি, তবে ন্যায্যতার প্রশ্নে কোনোমতেই তাদের বিসিএস ক্যাডারের সুবিধা দেওয়াটা ঠিক হবে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা তাদের শতভাগ বেতন-ভাতা, এমপিওভুক্তি-করণের দাবি করে আসছেন। এগুলো তাদের ন্যায্য দাবি। যেখানে দেশব্যাপী বেসরকারি কলেজের বিশাল অংশ এই ন্যায্য দাবির পক্ষে লড়াই করছে, সেখানে লটারির মতো জাতীয়করণসূত্রে কেবল সরকারি চাকরিই নয়, পুরোপুরি বিসিএস ক্যাডারের মর্যাদা লাভের সুযোগ কি অন্যদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশার জন্ম দেয় না? এজন্যই দেখি গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজ করছে চরম অস্বস্তি। অনেকেই বলছেন, একই কলেজে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার থাকলে শিক্ষায় শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। আসলে কি তাই? বেসরকারি কলেজ-গুলোর সব শিক্ষকই এমপিওভুক্ত নন, কেউ পান কেউ পান না; এতে তো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে না।

জাতীয়করণকৃত শিক্ষকরা ক্যাডার হওয়ার যে আবদার করছেন তা তাদের অতিরিক্ত প্রত্যাশা, যা শোভনীয়ও নয়। ১৯৭৮ সাল। জিয়াউর রহমানের শাসনামল। এই সময়টাতে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে সরকারি করা কলেজ শিক্ষকদের শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত করার পর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই জটিলতা, সৃষ্টি হয়েছে অন্যায্যতা। এরপর জাতীয়করণ-কৃত কলেজ শিক্ষকরা, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কিছু নেতৃস্থানীয় স্বার্থান্বেষী সদস্য ও কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি আমলার যোগসাজশে আত্তীকরণ বিধিমালা-২০০০ প্রণয়নের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস (সাধারণ) শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির পথ সুগম করা হলে এই জটিলতা বৃদ্ধি পায়। ওই সময়গুলোতে অল্পবিস্তর কলেজকে জাতীয়করণ করা হতো বিধায় তা অন্যদের কাছে তেমন প্রকটরূপে ধরা দেয়নি। কিন্তু প্রেক্ষাপট এখন ভিন্ন। একসঙ্গে জাতীয়করণ হওয়া ২৮৩টি বেসরকারি কলেজের ১৪-১৫ হাজার শিক্ষক যদি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সুযোগ পান তবে যারা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মূল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ-গ্রহণের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের প্রতি বঞ্চনা করা হবে। তারা প্রমোশনগত জটিলতার মধ্যেই কেবল পড়বেন না, বিসিএস ক্যাডারের মর্যাদাও হ্রাস পাবে। অন্যান্য ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাহলে শিক্ষার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা কোনোমতেই বাঞ্ছনীয় নয়।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

 

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029759407043457