অধ্যাপক হাসান ওয়াইজশিক্ষা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়

এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার |

অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ  এবং তাঁর বাবা অধ্যাপক আবু হেনা ছিলেন বিরল প্রকৃতির ভালো মানুষ। তাঁরা ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, নিয়মনিষ্ঠ ও দক্ষ প্রশাসক। তাঁরা ছিলেন কঠোর ও কোমলের সমাহার। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন কোমলপ্রাণ ও শিক্ষার্থীবৎসল। প্রশাসক হিসেবে ছিলেন দক্ষ, বন্ধুবৎসল, কিন্তু প্রয়োজনে কঠোর। নিজেরা নিয়ম-নীতির মধ্যে চলতেন, অন্যরাও যাতে নিয়ম-নীতি মেনে চলেন, তা নিশ্চিত করতেন।

অধ্যাপক আবু হেনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের প্রভোস্ট ছিলেন। আমি ওই সময়ের ছাত্রদের কাছে অধ্যাপক আবু হেনার গল্প শুনেছি। তাঁর ছাত্ররা প্রাণ খুলে অধ্যাপক হেনার প্রশংসা করতেন ও করেন। সম্প্রতি কুমিল্লার একটি নামকরা কলেজের একজন অধ্যক্ষ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অধ্যাপক আবু হেনা ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক।  তাঁর পুত্ররাও বাবার থেকে কম গুণী নন।’

অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ এবং আমি প্রায় দুবছর একসঙ্গে কাজ করি। আমি গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। তিনি আজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ। জেলা প্রশাসক কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। তবে কলেজের অধিকাংশ  কাজই জেলা প্রশাসকের পক্ষে আমাকেই করতে হয়। তাই হাসান ওয়াইজ সাহেব এবং আমার মধ্যে ঘনিষ্ঠ কর্মসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে কর্মসংযোগ আত্মার সংযোগে রূপান্তরিত হয়।

যে কোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি  থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। যৌক্তিক আচরণকে দ্বিতীয় ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা যায়।  উভয় ক্ষেত্রেই অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ ছিলেন অসাধারণ। তিনি বয়সে আমার অনেক বড়ো। গাজীপুরে আসার আগে পদেও তিনি আমার থেকে অনেক বড়ো ছিলেন।  

অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ আশির দশকের মাঝামাঝি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অতঃপর তাঁকে সিলেট এম সি কলেজে বদলি করা হয়। তিনি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত  সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সিলেট  থেকে তাঁকে পাঠানো হয়  যশোর। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেখান থেকে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আমরা গাজীপুর আজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষের শূন্য পদ পূরণের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করি। নির্ধারিত তারিখে প্রার্থীরা হাজির হন। মোট ৮ জন প্রার্থী ছিলেন। আমার সভাপতিত্বে বাছাই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসান ওয়াইজ সাহেব ছিলেন সেরা প্রার্থী। ফলে নতুন অধ্যক্ষ খুঁজে পেতে আমাদেরকে বেগ পেতে হয়নি। 

কাজী আজিম উদ্দিন কলেজ গাজীপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বেসরকারি কলেজ। তবে স্বচ্ছল ও সুনামধারী। কলেজটি প্রাচীন নয়। কলেজটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই। এখন কলেজটির বয়স মাত্র ৪২ বছর। সবার মুখে মুখে শোনা যায়, গত ৪২ বছরের মধ্যে হাসান ওয়াইজ সাহেব ছিলেন এ কলেজের সেরা অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ হিসেবে সব মানদণ্ডেই তিনি সেরা। একজন সেরা মানুষকে বাছাই করতে পারার কৃতিত্ব আমাকে আনন্দ দেয়। আমি মনে করি, কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক হাসান ওয়াইজের মতো একজন উঁচু মাপের শিক্ষককে বছাই করতে পারা আমার কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি।

গাজীপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সাহেবকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা জরুরি। কারণ তিনি আমাকে অধ্যক্ষ বাছাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সাহেবের উল্লেখযোগ্য দুটি গুণের কথাও বলা সমীচীন। তিনি কোনো নিয়োগেই কোনো হস্তক্ষেপ করতেন না। গাজীপুর জেলায় অনেক নিয়োগ কমিটিতে আমি নেতৃত্ব দিয়েছি। একটি ক্ষেত্রেও জেলা প্রশাসক হস্তক্ষেপ করেননি।  আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছি। তবে আমার সমপর্যায়ের কারো কারো আত্মীয় স্বজনকে চাকরি দেয়ার জন্য কখনো কখনো চাপ ছিলো। সেটা আমি শুনিনি। তবে এজন্য ২৫ বছর ধরে খেসারত দিতে হচ্ছে। 

জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের  কাজটি সততা ও  নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। এ দুটি নির্বাচনে তিনি কোনো অনিয়ম করতে দেননি, নিজেও করেননি। 

ফিরে আসি অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন একান্তই সময়নিষ্ঠ একজন মানুষ। তাঁর বাসা ছিলো মোহাম্মদপুর। সেখান থেকে  তিনি মহাখালী যেতেন। মহাখালী থেকে বাসে গাজীপুরের পুকুরপাড় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতেন। সেখান থেকে রিকশায় কলেজে। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। তা সত্ত্বেও ঝড়, বৃষ্টি,  শীত কোনো কিছুই তাঁর সময় সময়ানুবর্তিতায় আঘাত হানতে পারেনি। তিনি সবকিছু উপেক্ষা করে কলেজের কার্যক্রম শুরুর আধাঘণ্টা আগে কলেজে উপস্থিত হতেন। একদিনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রতিদিনই তিনি সবার পরে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করতেন। একদিনও এ অভ্যাসেরও ব্যত্যয় ঘটেনি। 

সময় নিষ্ঠতায় তিনি ছিলেন রোল মডেল। বর্তমান প্রজন্ম বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারেন। একজন ষাটোর্ধ মানুষ ‘তিন ভাঙার’ যাতায়াতে করে যদি প্রতিদিন সময় অনুযায়ী সব কাজই করতে পারেন, তারা কেন পারেবন না?

বড়ো সাহেবদের নির্ধারিত সময়ের পর অফিসে থাকা সমীচীন নয়। এতে জুনিয়রদের ওপর অবিচার হয়। তিনি অফিসের নির্ধারিত সময়ে সব কাজ শেষ করতেন, সময় মতো সবাইকে ছেড়ে দিতেন। নিজেও সময়মতো ঘরে ফিরতেন। যাঁরা রাত অব্দি অফিস করেন, তাঁরা ভাবতে পারেন, বড়ো সাহেব রাত দশটায় অফিস ত্যাগ করেন। তিনি চটজলদি গাড়িতে ওঠেন, দ্রুত বাসায় অথবা ক্লাবে পৌঁছে যান। কিন্তু স্টাফ বাস মিস করে তাঁর পিও, পিয়ন কিভাবে মিরপুর অথবা উত্তরার বাসায় ফেরেন!  ঘরের মানুষগুলোর প্রতি মায়া না থাকলে, দূরের মানুষদের  জন্য কী ভালো কিছু করা যায়! এ ক্ষেত্রে হাসান ওয়াইজ ছিলেন একজন মানবতাবাদী মানুষ। তিনি অনুজ সহকর্মীদের ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন,  প্রয়োজনে কঠোরও হতেন। তাঁর মধ্যে অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খানের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

অধ্যক্ষত্ব শুধু শিক্ষকতা বা চাকরি নয়। এটি লিডারশিপ বা কমান্ডারশিপের চাকরি। তিনি ছিলেন একজন সাচ্চা প্রশাসনিক লিডার।  তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী ছিলো  দৃশ্যমান।  তিনি সবাইকে নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর অধ্যক্ষত্বকালে কলেজে কোনো দলাদলি ছিলো না। তখন কাজী আজিম উদ্দিন কলেজ ছিলো এক আদর্শ বিদ্যাপীঠ।

তিনি খাপ খাইয়ে চলতে পারতেন। তিনি অন্যকে সম্মান করতে এবং নিজের সম্মান হেফাজত করতে জানতেন। তিনি  ছিলেন মিশুক, কিন্তু  আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। তাঁর মাঝে হাসি হাসি মুখ ও ভাবগাম্ভীর্য দুটোই ছিলো। তিনি আপন হতে এবং আপন করে নিতে জানতেন। 

তিনি ছিলেন স্বকীয়। নিজের কাজ স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাধীনভাবে করতেন। আবার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। তাঁর চোখে সবসময়ই ভালোবাসা দেখেছি। কখনোই অবিশ্বাস, অনাস্থা বা বিদ্বেষ দেখিনি। তিনি পারস্পরিক শ্রদ্ধার নীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে জয় করতেন।

তাঁর আর্থিক ও নৈতিক সততা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিলো না। তিনি সাদামাটাভাবে জীবন-যাপন করতেন। তবে রুচিশীল ছিলেন। একজন অধ্যক্ষের জন্য মানান সই কাপড় পরতেন।

অধ্যক্ষ হাসান ওয়াইজ ছিলেন শিক্ষা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক রোল মডেল। দৈহিকভাবে তিনি বিদায় নিলেও তাঁর  আদর্শ কখনো হারিয়ে যাবে না। তাঁর কর্মের দীপ্তি অনেক বছর ধরে অনেকের মনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিলেট এম সি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বাবা অধ্যাপক আবু হেনা ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিলেট এম সি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এম সি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে। গত ১৪১ বছরে তাঁরাই একমাত্র পিতাপুত্র অধ্যক্ষ। পিতা ও পুত্র দু'জনই ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র।  তবুও কার কী গুণ ছিলো, কে বেশি সেরা ছিলেন, এ বিষয়ে একটি গবেষণা করা যেতে পারে।  

অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ এবং সিলেট এম সি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আজ সিলেটের মানুষ তাঁকে প্রাণ খুলে স্মরণ করেছে। ময়মনসিংহের মানুষের তেমনটি চোখে পড়েনি। তবে এমনও হতে পারে যে, ময়মনসিংহেরটা আমার চোখে পড়েনি। এমন একজন ভালো মানুষকে ময়মনসিংহের মানুষও নিশ্চয়ই ভালোবাসেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অধ্যক্ষ আবু হেনা এবং অধ্যক্ষ হাসান ওয়াইজকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করুন। তাঁদের পরিবার-পরিজনকে ভালো রাখুন।

আমিন।

লেখক : এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার, সাবেক সচিব, লেখক ও গবেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প বিসিএসে আনুকূল্য পেতে যেচে তথ্য দিয়ে বাদ পড়ার শঙ্কায় - dainik shiksha বিসিএসে আনুকূল্য পেতে যেচে তথ্য দিয়ে বাদ পড়ার শঙ্কায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগ নেতাকে উপাচার্যের পিএস নিয়োগ - dainik shiksha বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগ নেতাকে উপাচার্যের পিএস নিয়োগ ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ জাল সনদে চাকরি করছেন এক বিদ্যালয়ের সাত শিক্ষক - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছেন এক বিদ্যালয়ের সাত শিক্ষক কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ছাত্র আন্দোলনে নি*হত ৯ মরদেহ তোলার নির্দেশ - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নি*হত ৯ মরদেহ তোলার নির্দেশ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032210350036621