রাজধানীর উত্তরা থেকে অভিনব পন্থায় শিশু অপরহণকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলশ।
সম্প্রতি দুই শিশুকে অপহরণের কথা বলে কৌশলে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা তদন্তে নেমে তাদের শনাক্ত করে ডিএমপির উত্তরা বিভাগ।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- চক্রের মূলহোতা মো. মিল্টন মাসুদ (৪৫), শাহীনুর রহমান (৩৮) ও সুফিয়া বেগম (৪৮)।
শুক্রবার (৫ মে) গাজীপুরের সালনা হতে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ জানায়, এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ঘোরাফেরা করে। তাদের টার্গেট আট থেকে ১৬ বছরের শিশু। যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না, তবে বাবা-মায়ের মোবাইল নম্বর মুখস্ত।
স্কুল ফেরা বা বাজার থেকে ফেরা শিশুদের সঙ্গে কৌশলে পরিচিত হয়। এরমধ্যে কথার ছলে পরিবারের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে। কিছু সময় শিশুদের সঙ্গে গল্প করতে করতেই ওই শিশুর পরিবারের কাছে ফোন করে অপহরণ হয়েছে বলে মুক্তিপণের ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়।
মারধরের হুমকি বা শিশুর হাত-পা ভেঙে দেয়ার কথা বলে মুক্তিপণ আদায় করা হলেও শিশুদের সঙ্গে খুবই মানবিক আচরণ করা হতো। চক্রটি এভাবে ৫-৬ বছরে অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ শিশুকে অপহরণ করে কৌশলে মুক্তিপণ আদায়ের পর আবার ছেড়ে দিয়েছে।
ঘটনার বিবরণে পুলিশ জানায়, চক্রটির অপহরণের শিকার বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুলের ক্লাস এইটের শিক্ষার্থী মাহির আশরাফ।
৩ মে স্কুল থেকে ফেরার সময় মিল্টন নামের লোকটি শিশুটির সঙ্গে কথা বলে পরিবারের খোঁজখবর নেয়। এরপর শিশুটির বাবার নম্বর নিয়ে ফোন দিয়ে শিশুটিকে কথা বলায়। এরপর তিনি ফোনটা কেটে দেয়। এরমধ্যে শিশুটি স্কুল থেকে কোচিংয়ে চলে যায়। বাসায় ফিরে শিশুটি জানতে পারে, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। শিশুটির বাবা ভয় পেয়ে ২৫ হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে অপহরণের শিকার শিশু মুত্তাকীরের বাবা বাহউদ্দিন বলেন, ২৪ রমজানে আমি ইতিকাফে বসা ছিলাম। মাদরাসা থেকে ফোন আসে, আজকে থেকে ঈদের ছুটি। বাচ্চাকে কি বাসায় পাঠায় দেবে কিনা জানতে চায়। আমি পাঠাতে বলি, কিন্তু আধা ঘণ্টা পার হলেও মুত্তাকী বাসায় পৌঁছেনি।
বাসার দারোয়ান ফোন করে জানায় মুত্তাকী এখনো আসেনি। এর কিছুক্ষণ পরই মুত্তাকীর নম্বরে ফোন করলে মুত্তাকীকে অপহরণের কথা জানায়। দিশেহারা হয়ে মুত্তাকীরের মা টাকা পাঠায়। টাকা পাওয়ার পর টঙ্গি বাজারে একটি হোটেলের ঠিকানা দিয়ে অপহরণকারীরা বলে মুত্তাকী সেখানে আছে।
ডিএমপি উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, গত ২৪ মার্চ উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের হলি ল্যাবের সামনে থেকে ৬ বছরের শিশু শাহিন শেখ হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ছেলের সন্ধান না পেয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি জিডি করে পরিবার। জিডি তদন্তের সূত্র ধরে প্রথমে অপহরণকারী চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়।
মোর্শেদ আলম বলেন, এই অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে স্কুল, বাজার, রেস্টুরেন্টসহ নানা জায়গায় একা থাকা ও বাবা মায়ের সঙ্গে ঘুরতে থাকা শিশুদের টার্গেট করে। কৌশলে আর্থিক অবস্থা, বাবা-মায়ের নাম, পেশা জেনে নেয়। এরপর মোবাইল নম্বর নিয়ে কথা বলে। এরপর সুকৌশলে কিছু সময় অপহরণকারীরা হেঁটে কিছু দূর সামনে নিয়ে যায়। এরমাঝে শিশুটির পরিবারের কাছ থেকে মোবাইলে বিকাশ, নগদের মাধ্যমে টাকা দাবি করে।
সাধারণত অপরণকারীরা অপহরণের পর নির্যাতন করে টাকা আদায় করে। কিন্তু এই চক্রটি অপহৃতের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী পরিবারের স্বামর্থের ওপরেও মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এমনও হয়েছে ৫শ টাকা নিয়েও অপহৃত শিশুকে ছেড়ে দিয়েছে। আবার কখনো টাকা না নিয়েও অপহৃত শিশুকে একদিন পর ছেড়ে দিয়েছে।
ডিসি বলেন, অপহরণকারীরা কোনো ধরনের নির্যাতনমূলক বা হুমকি-ধামকি না দেওয়ার কারণে কেউ থানায় অভিযোগ করতেন না। চক্রটি অল্প সময়ের জন্য অপহরণের কৌশল ব্যবহার করতো। খুব কমই কাউকে আটকে রাখত।
চক্রের মূলহোতা মিল্টন মাসুদের বিবিষয়ে পুলিশ জানায়, মিল্টন মাসুদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অপহরণ মামলা রয়েছে। এরমধ্যে গাজীপুরে তিনটি, ডিএমপিতে দুইটি। তিনি মাদকসেবী, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একাধিক বিবাহিত। তার পেশাই এই কৌশলে অপহরণ করা।
তার সহযোগী শাহীনুর রহমান নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলেও তিনিও ৬-৭ বছর ধরে এই অপহরণ চক্রে জড়িত। তিনি অপহরণের মুক্তিপণ বিকাশে সংগ্রহে করে দিতেন।
চক্রটি কতো বছর ধরে অপহরণে জড়িত ও কতজন শিশুকে অপহরণ করেছে জানতে চাইলে ডিসি বলেন, বিগত ৬-৭ বছর ধরে ৫শ থেকে ৬শ শিশুকে অপহরণ ও অন্তত ৩শ পরিবারে কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছ চক্রটি।
অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ডিসি মোর্শেদ বলেন, আপনারা বাচ্চাদের অপহরণ সংক্রান্ত বিষয়ে সতর্ক করেন। স্কুল ও কোচিং সেন্টারে যাওয়া আসার সময় অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা না বলা, মোবাইল নম্বর না দেওয়া ও কিছু খেতে দিলে না খাওয়ার জন্য সতর্ক করুন।