শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন কী?

মো. রহমত উল্লাহ্‌ |
Rahamat Ullah
মো. রহমত উল্লাহ্‌

সম্প্রতি ঘোষিত আদালতের একটি রায়ে মনে হয় খুব খুশি হয়েছেন বেসরকারি শিক্ষকগণ। তাদের হাসি দেখে মনে পড়ছে, সেই প্রবাদের কথা- বোকার তিন হাসি: একটা দেখে/শুনে, আরেকটা বুঝে/নাবুঝে, অন্যটা এমনিতেই। এই প্রবাদের কথা বলছি এই কারণে যে, আদালতের রায়ে আসলে তাদের খুশি হবার মত কিছুই ঘটেনি।

এই রায়ের ফলে এমপিগণ সভাপতি হতে পারবেন না, এমনটি নয়। রায়ে যা বলা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে, এমপিগণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে হলে কমিটির সদস্যগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। তারা এখন আর চারটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নয়, যত ইচ্ছা ততটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন।

কেননা, কমিটির সদস্যগণ তাদেরই লোক। তারা তাদের পেয়ারের নেতাকেই সভাপতি বানাবেন। অন্য কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগই দিবেন না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হবেন এমপিগণ। তারা এখন হবেন এলাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তাই যারা এমপিগণ বা এমপিগণের কর্মীগণ সভাপতি/সদস্য থাকছেন না মনে করে খুশি হয়েছেন, তাদের হাসি হচ্ছে বোকার হাসি।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে এমপিগণের সভাপতিত্ব বিলোপ হচ্ছে এমন ধারণায় শিক্ষকগণ খুশি হবার কারণ কী? কারণ, কমিটি গুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আর কল্যাণকর মনে করেননা অনেকেই। তারা মনে করেন কমিটি হচ্ছে রাহু। কমিটি নামক এই রাহুর কবলে পড়ে আজ অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধান এবং শিক্ষকগণ অতিষ্ঠ। যা প্রকাশ করার সাহস ও সুযোগ থাকে না শিক্ষকদের। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত কমিটির অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত লোকদের মন মতো কাজকর্ম না করলে, প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের চাকরি খান দুই তিন বেলা। সব কমিটির সব লোকই যে এমন মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। এই কথাগুলো আমি আগেও বলেছি আমার একাধিক লেখায়।

এমন একসময় ছিল, যখন কমিটির লোকজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করত, নিজেরা জমি দিত, টাকা দিত, শিক্ষকদের বেতন দিত, ঘর তৈরি করে দিত, শিক্ষাসামগ্রী দিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিত। তারপর এমন একসময় গেছে, যখন কমিটির লোকেরা নিজেদের অযোগ্য সন্তানদের বা টাকা খেয়ে অন্যের অযোগ্য সন্তানদের অথবা দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক বানাতো। সেই অযোগ্যদের কারণেই আজ যোগ্য শিক্ষকের বড় অভাব এই দেশে। যা খোদ শিক্ষামন্ত্রীও স্বীকার করেছেন কিছুদিন আগে। কমিটির নিকট থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা অতিসম্প্রতি কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রই স্বীকার করে নিয়েছে যে, কমিটি শিক্ষক নিয়োগে চরম অনিয়ম করত। আর এখন কমিটি অলিখিত অঘোষিতভাবে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের বা বদলের অনিয়ম। কমিটির লোকদের এখন আর কাজ কী?

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার শতভাগ বেতন দেয়। সাধ্যমতো ভাতা দেয়। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো তৈরি করে দেয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। বিনামূল্যে বই দেয়। শিক্ষাসামগ্রী দেয়। আর শিক্ষার মান যাচাই করার জন্য, শিক্ষকদের কাজ তদারক করার জন্য প্রতি থানায়/উপজেলায় রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী অফিসার ও পরিদর্শক। সরকারের পক্ষে তারাইতো পারে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক দেখবাল করতে। এ ছাড়াও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণী অনলাইনের মাধ্যমে জমা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে।

ডায়নামিক ওয়েব এপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও একাডেমিক কাজের সচ্ছতা। ভর্তি হচ্ছে অনলাইনে, ভর্তি ফি নির্ধারণ করছে সরকার, টিউশন ফি নির্ধারণ করছে সরকার। শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। তাহলে এখন আর কেন প্রয়োজন পরিচালনা কমিটি নামক এই রাহু? কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত নিজেদের মালিক আর শিক্ষকদের তাদের কেনা গোলাম ভেবে অহেতুক দাবড়ানো ছাড়া তাদের আর ভালো কাজ কী এখন? তারা অনেকেই মনে করেন প্রতিষ্ঠানের টাকা মানেই তাদের টাকা।

তারা প্রতিষ্ঠানের পুকুরের মাছ নেয়, খামারের ফসল নেয়, গাছের ফল নেয়, দোকানের ভাড়া নেয়, জমির দখল নেয়, গাছপালা নেয়, ফ্যান-লাইট নেয়, ইটা-বালি-সিমেন্ট নেয়, ঠিকাদারি নেয়, সাপ্লাই কাজ নেয়, ছাপা কাজ নেয়, টিফিন সাপ্লাই দেয়, শিক্ষকদের ডিউটির টাকার ভাগ নেয়, টিএ-ডিএ নেয়, মিটিং করার দিন সম্মানীর নামে টাকা নেয়, নিজেদের কাজে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি নেয়, প্রতিষ্ঠানে আয়া-পিয়ন বাসায় নেয়, ফেল/বখাটে শিক্ষার্থীর পক্ষ নেয়, নিজের পছন্দের শিক্ষকদের ইংরেজি/অঙ্ক ক্লাস দেয়, ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই শিক্ষকের ভুল ধরার নামে বকাবকি করে, কথায় কথায় সোকেস (সোকজ বলতে জানেনা) দেয়, নিজেদের সন্তানদের বিনা টাকায় প্রতিষ্ঠানে এমনকি প্রাইভেটেও পড়াতে বাধ্য করে। আরো কত কী যে করে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি/সদস্য হওয়া এখন আর সেবামূলক কাজ নয়; বিভিন্নমুখী লাভজক কাজ। তাই তা হওয়ার জন্য সবাই মরিয়া। এমপিরা-মন্ত্রীরা এই পদ/পদের ক্ষমতা ছাড়তে চান না। তারা নিজেরা বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের দখলে রাখতে চান কমিটির সব পদ। আবার ডিসি-ইউএনওরাও হতে চান সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তারা ২০/৩০ টি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারলে প্রতি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মিটিং এ সম্মানী বাবদ পেয়ে যান হাজার হাজার টাকা। তাদের দপ্তরে গিয়ে করতে হয় মিটিং। তাই খুশি রাখতে হয় তাদের অফিস ম্যানদের। সেখানেও ব্যয় হয় প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষকগণ বেতন-ভাতা পাক বা না পাক এই সব সম্মানী পরিশোধ করতে হয় প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে। সভাপতি নিজেই নির্ধারণ করেন তিনার সম্মানীর পরিমান। যে প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা দিতে সক্ষম সে প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় দ্রুত। ঝাড়ি খেতে থাকেন গরিব প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ। এসব জেনেও যেন না জানার ভান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তাছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে যে সামান্য ভাতাদি পান শিক্ষকগণ, তা যেন কমিটির লোকদের দয়ার দান। শিক্ষামন্ত্রী নিজে শিক্ষকদের স্যার বলেন কিন্তু কমিটির লোকেরা শিক্ষকদের স্যার বলতে চান না; বরং তারা চান যে শিক্ষকরা ও প্রধানরা জনসম্মুখে তাদের স্যার স্যার করুক। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকুক। তাদের কথায় কান ধরে উঠবস করুক এবং তাই হয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। তারা ভুলে থাকেন যে শিক্ষকরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। এমনকি যে শিক্ষার্থীর বাবা-মা কমিটির সদস্য হন সেই শিক্ষার্থীও খবরদারি করেন শিক্ষকগণের ওপর। শুধু তাই নয়, কমিটির সভাপতি/সদস্যের দলের, বয়সের, বাড়িঘরের সবাই খবরদারি করেন শিক্ষকদের ওপর এবং তা মানতে বাধ্যও হন শিক্ষকরা। না হলে চোখ মুখ বন্ধ করে মেনে নিতে হয় এই শ্যামল কান্তির মতো পরিণতি। আমি আবারো বলছি, সব কমিটির সব লোকই যে মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।

এহেন পরিস্থিতিতে প্রচলিত কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিধান বাতিল করে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্বিঘ্নে শিক্ষকতা করার ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সেইসাথে প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ।

লেখক: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023410320281982