শুরুতেই একটা মজার ঘটনা। সত্য ঘটনা, বানোয়াট কিছু নয়। দেশের দক্ষিণের শেষ প্রান্তের জেলা বরগুনার বেতাগী উপজেলার প্রধান মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেতাগী হাইস্কুলের কম্পাউন্ডে ঘটেছিল এটি।
তখন বরিশাল জেলার একটা থানা সদর হচ্ছে বেতাগী। ষাট দশকের মধ্যভাগের ঘটনা। হঠাৎ একদিন স্কুলের ছাত্র হোস্টেলের রান্নাঘরে বিদ্যালয়টির ‘আর্মি-মেজাজের’ শরীরচর্চা শিক্ষক (সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ননকমিশন্ড অফিসার/‘হাবিলদার’ ধরনের) রব স্যার বাবুর্চিদের পাশে সরিয়ে রেখে ডুবো তেলে কয়েকটা টাটকা মাছ (আস্ত মাছ/রুই জাতীয়) ফ্রাই করছেন, তার সুগন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। প্রায় এক কেজি সাইজের রুই মাছের ‘আস্ত সাইজ’ ফ্রাই ছাত্ররা কল্পনা করতেও ভয় পায়।
ছাত্ররা কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছেন সেই দৃশ্য। স্কুল হোস্টেলের রান্নাঘরে ওই আকারের মাছ বা ওই স্ট্যান্ডার্ডের রান্না কেউ কখনো দেখেনি। অনেক চেষ্টায় জানা গেল-স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন দামি এক মানুষ, জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর, তার জন্য এ বিশেষ রান্না। শিক্ষার্থীরা তো হতবাক! খোদ রব স্যার রান্না করছেন স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেবের জন্য! ঘটনাই বটে!
কারণ, স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব স্কুল পরিদর্শনের রিপোর্ট ভালো না দিলে স্কুলের সরকারি বরাদ্দ জুটবে না (অথবা বরাদ্দ কমে যাবে), তাই প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে এ বিশেষ রান্নার আয়োজন। সেই রান্না করা দামি খাবার ছাড়াও স্কুল পরিদর্শক সাহেবের সেবায় আরও কী কী ব্যবস্থা হয়েছিল তার খবর তো শিক্ষার্থীরা কেউ রাখেনি (সেই সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জানা এ ঘটনা)।
শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ‘বিচিত্র-ঘুস’ প্রদানের সেই প্রথা কি এখনো এ ছয় দশকেও দূর হয়েছে? মোটেই না, গিয়ে দেখুন সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোতে-শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের সব টেবিল-চেয়ার, আলমারি অবধি বিশেষ উপঢৌকন বা কড়কড়ে নোটের বান্ডিলের জন্য ‘হা-মুখ’ করে আছে।
ভবন উঠছে, কেবলি ভবন-পাঁচতলা, সাততলা, দশতলা বা আরও বেশি তলার ভবন। স্কুল কলেজগুলোর জন্য কেবল ভবন উঠছে, স্কুল-কলেজের ক্লাসরুম ভবন, প্রশাসনিক ভবন, হোস্টেল ভবন ইত্যাদি। নানা ব্যক্তিদের নামে সেসব শিক্ষালয় বা ভবনের নাম, নানারকম মতলববাজির তৎপরতা। রাষ্ট্রের গণমানুষের করের অর্থে চলে এসব ভবন বিলাসিতা।
কিন্তু আসল লেখাপড়া কতটুকু চলে! ভবন নির্মাণ বাড়লে বড় কর্তাদের পকেট ভরবে, মন ভরবে তারও চেয়ে বেশি। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রমের উন্নতি, সে তো পেছনে দৌড়ে পালাতেই থাকবে। সে যত ঘুসের রাজত্ব দেখবে, ততই দৌড়ে পালাতে থাকবে শিক্ষালয় থেকে আরও দূরে।
আমরা চাই শিক্ষাঙ্গনে প্রকৃত উন্নয়ন-দরকারি শিক্ষাভবন, অন্যসব ভবন, প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জাম সবকিছু। সেগুলো আসতে হবে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত লেখাপড়ার চাহিদামতো। কোনোরকম বাড়াবাড়ি নয়, কোনোরকম ঘুস-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ যেন না ঘটে।
শিক্ষার্থীর আসল লেখাপড়ার জন্য ভালো শিক্ষক যেমন অপরিহার্য, তেমনি শিক্ষা প্রশাসন কীভাবে শিক্ষাদান ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে পরিচালন করেন, তা বিবেচনা একটা জরুরি বিষয়। বস্তুত, শিক্ষা ব্যবস্থাপনাটা শুধু ভালো শিক্ষকের ক্লাসরুম শিক্ষাদানের রুটিনওয়ার্কের ওপরে নির্ভর করে না, শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কর্মদক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার ওপরে নির্ভর করে সামগ্রিক শিক্ষা পরিচালনার সাফল্য। আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ক্ষেত্রে গভীরভাবে লক্ষ করলে কী দেখি?
সরকারি স্কুল ও সরকারি কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রশাসন চলে এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়। স্কুল পরিদর্শক, কলেজ পরিদর্শক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, প্রতিটি বিভাগের প্রধান বা চেয়ারম্যান বা ইনস্টিটিউটের পরিচালক, বিশেষভাবে শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাদান, পরীক্ষা গ্রহণ তৎপরতা ইত্যাদির সফল পরিচালনা করার একটা প্রশাসনিক কার্যক্রম ও তার শৃঙ্খলার মধ্যে শাসন-অনুশাসন দিয়ে চালিয়ে নিতে চান তাদের নিজ নিজ শিক্ষা কার্যক্রম।
প্রাইভেট স্কুল-কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলে যথাক্রমে তাদের হেডমাস্টার, প্রিন্সিপাল বা ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যসব প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শিক্ষা-প্রশাসন পরিচালনার প্রক্রিয়ায়। সরকারি স্কুল-কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা যতটুকু কার্যকর রাখার চেষ্টা করা হয়, তারও একটা হিসাব মিলে, কিন্তু প্রাইভেট স্কুল ও কলেজ এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের কার্যকর ব্যবস্থা কখনোই ভালোভাবে সক্রিয় রাখা যায় না।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই শৈথিল্যে ভরা থাকে। এর মূল কারণ, অর্থাভাবে তারা সব স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় সদা বাধার সম্মুখীন হয়। আবার অদক্ষতা ও দুর্নীতির মানসিকতার কারণে সব শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাই দায়সারা দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
সরকারি বা বেসরকারি সব বিদ্যালয় চলবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে। সবার লক্ষ্য হবে একটাই-প্রতিটি নতুন প্রজন্মের মানুষের যারপরনাই ভালো লেখাপড়া। সবাইকে গণশিক্ষা ও গণসংস্কৃতির সাধু পাঠদান-উপযুক্ত প্রশাসনিক শৃঙ্খলায়, উপযুক্ত শিক্ষা সরঞ্জামাদি সহযোগে।
আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কী দেখতে পাই? ভূগোল শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানচিত্র বের করেন না। কারণ, তার হাতে সময় নেই, তিনি অতটা পরিশ্রম করতেও রাজি নন। বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ল্যাবরেটরিতে ঢোকানোই হলো না, অথচ ক্লাস নেওয়া হয়ে গেল। স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি ফাঁকা, বই নেই, সেখানে পাঠক নেই।
সেটা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যেমন চলেছে, এই ২০২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দেও চলে। বিদ্যালয়ের, মহাবিদ্যালয়ের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধান কর্মকাণ্ডে সিরিয়াস হতে হবে। হেলাফেলা করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে সেই হেলাফেলা করে যেনতেন পদ্ধতির ক্লাস নেওয়া হয়। প্রাকটিক্যাল ক্লাসগুলো আর প্রাকটিক্যাল নেই। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা নড়বড়ে, ঠিকভাবে প্রশ্নপত্র গোপনীয়তার নিশ্চয়তা লঙ্ঘিত হয় অকাতরে।
ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে নানারকম প্রশ্ন ওঠে, পরীক্ষকদের সততাও নিশ্চিত হয় না। এমনকি পরীক্ষার ফলাফল অবিশ্বাস্য রকম ‘উলটাপালটা’ হলেও পরীক্ষার্থী চ্যালেঞ্জ করে পুনঃপরীক্ষার যথাযথ সুযোগ পান না। পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনঃমূল্যায়ন হলেও ছাত্রছাত্রীরা সুবিচার থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়।
এসব অভিযোগ দু-চারটি নয়, শত শত, কখনো বা হাজার হাজার। শিক্ষা প্রশাসন এসব নিয়েও হেলাফেলা করায় বহু শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল উলটে গিয়ে জীবনের ভবিষ্যৎ শিক্ষা অগ্রগতি ধসিয়ে দেওয়া হয়। তাই যথাযথ পুনঃপরীক্ষা বা পুনঃমূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিক্ষা প্রশাসনের দক্ষতা অর্জন ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিকতা ও সততাও থাকতে হবে প্রশ্নাতীতভাবে।
খায়রুল কবির খোকন : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ-সদস্য ও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক
সূত্র : যুগান্তর