শিক্ষা ভবনের সব টেন্ডার যুবলীগের শফিকের কবজায়

নিজস্ব প্রতিবেদক |

শিক্ষা ভবনে ত্রাসের নাম টেন্ডার শফিক। তাঁর পুরো নাম মো. শফিকুল ইসলাম। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রায় সব কাজেই তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ তো নেনই, অন্য কেউ কাজ নিলেও তাঁকে কমিশন দিতে হয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি সব সরকারের সময়ই তিনি এককভাবে রাজত্ব করে যাচ্ছেন শিক্ষা ভবনে। শিবির আর ছাত্রদলের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হলেও পরে একসময় তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও বর্তমানে তিনি যুবলীগের নেতা। আর এই পরিচয়েই এখনো পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন টেন্ডারবাজি। দৈনিক কালেরকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত  এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। 

প্রতিবেদন আরো জানা যায়, শফিকুল ইসলাম নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। সেখানেই শিবিরের হাত ধরে তাঁর রাজনীতিতে পদার্পণ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে ভর্তি হয়ে চলাফেরা করতেন ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগে যোগ দেন শফিক। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এর পর থেকেই মূলত তাঁর ‘টেন্ডারবাজি’ শুরু। 

অপর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিভিন্ন গণমাধ্যমের কার্ডধারী শিবিরের নেতা-কর্মীদের অর্থ সহায়তা করেন। যা শিক্ষাভবনে ওপেন সিক্রেট। 

দৈনিক কালেরকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটির বিস্তারিত: 

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, মূলত ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর ও শিক্ষা ভবনে থাকা প্রায় ১৪টি প্রকল্পের ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় জড়িয়ে পড়েন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইসিটি বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফিক।  ছাত্রদলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক ও সন্ত্রাসী নাসির উদ্দিন পিন্টুর বাহিনীরা সাথে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়ান শফিক।

শফিকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম শফিক এন্টারপ্রাইজ। এ ছাড়া আরো একাধিক নামে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে। বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই তাঁর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ চলমান। প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদারি আর কমিশন বাণিজ্য করে তিনি এখন প্রায় হাজার কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় রয়েছে পাঁচ-সাতটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। ঢাকার দক্ষিণখানের ২৩৪ হলান রোডে দুই বিঘার ওপর জমিতে বিশাল বাংলো বাড়িতে তিনি থাকেন। এ ছাড়া হাতিরপুর, গুলশান, উত্তরায় আছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজায় তাঁর ৩০টির মতো দোকান আছে। তাঁর অফিসের ঠিকানা ৬৯ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড (৫ম তলা), হাতিরপুল, ঢাকা। 

জানা যায়, ঠিকাদারি তাঁর মূল পেশা নয়। তাঁর মূল পেশা টেন্ডারবাজি। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট যেকোনো কাজ যেই পাক না কেন প্রতিটি টেন্ডারে ৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয় শফিককে। এর মাধ্যমেই মূলত তিনি বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। তিনি শিক্ষা ভবনে গেলে সঙ্গে থাকে একাধিক গাড়ি। নিজে একটি গাড়িতে থাকেন। আর শিক্ষা ভবনের দুই গেটে থাকে আরো দুটি গাড়ি। সঙ্গে থাকে দলবল। সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকেন তাঁর ডানহাত হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সোহেল রানা মিঠু, আর বামহাত হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন মাসুদ।

সূত্র মতে, শিক্ষা ভবনে মিজান গ্রুপ নামে আরেকটি গ্রুপ আছে। ওই গ্রুপের নেতা মিজানুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তবে তিনি শফিক গ্রুপের সঙ্গে পেরে না উঠে কখনো তাঁর সঙ্গে হাত মেলান আবার মাঝেমধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। বর্তমানে দুজনের সম্পর্ক ভালো নয়। গত বছরও শিক্ষা ভবনে এই দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়েছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তেরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘শফিকের বর্তমানে যে পরিমাণ সম্পদ আছে এর বৈধ হিসাব তিনি কখনোই দিতে পারবেন না। কারণ তিনি তো ঠিকাদারির চেয়ে টেন্ডারবাজি বেশি করেছেন। জোর করে কমিশন আদায়ই তাঁর মূল পেশা। যদি দুদক ও এনবিআর তাঁর সম্পদের হিসাব চায় তাহলে তিনি তা কখনোই দিতে পারবেন না। কিন্তু যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন তাদের সঙ্গে মিশে তিনি বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন।’ এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য শফিকুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রবিবার বিকেলে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, শফিক গ্রুপের আতঙ্কে তটস্থ হয়ে পড়েছেন শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তারা। শফিকের লোকজন ইদানীং প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। এমনকি টেবিল চাপড়ানো, দরজায় লাথি মারার ঘটনাও ঘটছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত জুন মাসের শেষ দিকে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রগ্রামের (সেসিপ) অধীনে আসবাব, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র কেনার দরপত্র চূড়ান্তকরণের কাজ চলছিল। ওই সময় মাউশি অধিদপ্তরের এক উপপরিচালকের কক্ষে গিয়ে নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখায় শফিকের লোকজন। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খবর দিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাধ্য হয় মাউশি অধিদপ্তর। কিন্তু ওই কর্মকর্তা এখনো ভীত। তিনি বদলি হওয়ার চেষ্টা করছেন। জামাতপন্থী এই উপপরিচালকের বিরুদ্ধেও রয়েছে টেন্ডারবাজদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ। 

এরপর জুলাই মাসের শুরুতে অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের এক সহকারী পরিচালকের কক্ষে গিয়ে শফিকের লোকজন ভয়ভীতি দেখায়। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় টেবিল চাপড়ায় এবং দরজায় লাথি মারে। ওই কর্মকর্তাও মহাপরিচালককে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন বিষয়টি।

বর্তমানে ঢাকায় শফিকের যেসব কাজ চলছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা কলেজের ১০ তলা ভবন নির্মাণ, ধানমণ্ডি মহিলা কলেজের ছয়তলা ভবন নির্মাণ, নায়েমের একটি ভবনের সপ্তম থেকে দশম তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ, মিরপুর বাঙলা কলেজের একাডেমিক ভবন ও মাল্টিপারপাস হল নির্মাণ, সরকারি তিতুমীর কলেজের একাডেমিক ভবন ও ছাত্রাবাস নির্মাণ, ধামরাই টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবন নির্মাণ।

জানা যায়, ঢাকা কলেজে ১০ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ চারতলা পর্যন্ত করে ফেলে রেখেছে শফিক এন্টারপ্রাইজ। সেখানে একাধিকবার নিম্নমানের কাজেরও অভিযোগ উঠেছে। ধানমণ্ডি মহিলা কলেজে নিম্নমানের রড ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তিন নম্বর রড দিয়ে এই ভবনের কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রকৌশলীদের আপত্তিতে দুইবার রড পরিবর্তনে বাধ্য হয় শফিক এন্টারপ্রাইজ। এ ছাড়া শফিকের একাধিক কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করতে না দেওয়ায় তিনি নিজেই কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। তবে এখন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের নিয়মিতই হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। নিম্নমানের কাজ ধরতে গিয়ে প্রকৌশলীরাই এখন আতঙ্কে আছেন।

সূত্র মতে, কয়েক বছর আগেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে ইজিপি চালুসহ ইইডির আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মাঠপর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। ফলে নিজ নিজ অঞ্চলে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেনি শফিক গ্রুপ। তারা চায় ম্যানুয়ালি দরপত্র আহ্বান, যাতে তারা ইচ্ছামতো কাজ বাগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী তাতে কোনোভাবেই রাজি হননি। ফলে তাঁর বিরুদ্ধেও অপপ্রচার, হুমকি-ধমকি ও মামলা দিয়েছেন শফিক। ঠিকাদারদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় গত ৫ জুলাই ইইডি প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ শিক্ষা ভবনে একটি সভাও করে। সেখানে প্রকৌশলীরা জানান, ইজিপি ছাড়া কোনোভাবেই সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ যথাসময়ে ব্যয় করা সম্ভব নয়।

মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ দরপত্রই ই-জিপিতে হয়। কিন্তু ঠিকাদাররা অনেক সময় বুঝে আবার অনেক সময় না বুঝে চাপ দেন। কিন্তু আমাদের কাউকে ফেভার করার সুযোগ নেই। সরকারের যথাযথ নিয়ম মেনে যিনি যোগ্য হবেন, তিনিই কাজ পাবেন।’

জানা যায়, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ইইডিতে টেন্ডার দখলে গিয়ে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়েছিলেন শফিক। তখন মাউশি অধিদপ্তর ও ইইডির চার কর্মকর্তা-কর্মচারী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এরপর শফিককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তখন তাঁর নামে টেন্ডারবাজির মামলাও হয়েছিল। এর কিছুদিন পর শফিককে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে শফিক তাদের সঙ্গে মিশে দোর্দণ্ড প্রতাপে আবার টেন্ডারবাজি শুরু করেন। শিক্ষা ভবন, খাদ্য ভবন ও বিদ্যুৎ ভবনে টেন্ডারবাজি চালিয়ে যান। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে মিশে যান শফিক। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা ভবনের টেন্ডার নিয়ে মুহসীন হল ছাত্রলীগের মাহী গ্রুপের সঙ্গে তাঁর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে তাঁর নামে মামলাও হয়েছিল।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে দিকে শফিক আনুষ্ঠানিকভাবে যুবলীগে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি যুবলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। সর্বশেষ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমানের ভাতিজার সঙ্গে টেন্ডার নিয়ে বড় সংঘর্ষে জড়ান শফিক। তাঁর সঙ্গে তখন যোগ দেয় আরেক টেন্ডারবাজ মিজান গ্রুপ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046701431274414