শিক্ষিতরাই আক্রান্ত শিক্ষিতদের অদূরদর্শী কর্মে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

অনেক দিন ধরেই লেখাটি লিখব বলে ভাবছি। সাতপাঁচ ভেবে দ্বিধায় ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে দেশের স্বার্থে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া লেখাটির মাধ্যমে আমরা যারা শিক্ষিত ও কর্তাব্যক্তি, তাদেরও নিজের দায়িত্ববোধ নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখছি বলে অনেকের মনেই আমার চাকরিজীবনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। ২০০১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ যোগ্যতায় প্রভাষক পদে চাকরি পেয়েছিলাম। দেশ ও সরকারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ২০ বছরের কর্মজীবনে দুবার বিভাগীয় প্রধান ও একবার ডিনের দায়িত্ব পালন করেছি। এছাড়া কর্মজীবনে সিন্ডিকেট মেম্বার, হল প্রভোস্ট, পরিচালকের দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী প্রোগ্রামার পদে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে ১২০ জন নিয়োগ দিয়েছি। আমি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে পারি, এই নিয়োগগুলোতে কোনো দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি করি নাই। টাকার মাধ্যমে নিয়োগদানের বিষয়টিকে আমি মনে করি আমার মানবাত্মার অপমৃত্যু। তাই আমৃত্যু দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে চাই—এটাই আমার মাতৃভূমির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার। বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা হতো বংশপরিচয়। কিন্তু এখন সেসবের বালাই নেই। আমরা যারা ১১তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) পদে নিজের মনোনীত লোকদের নিয়োগের জন্য অনুরোধ করি, তারা এবং নিয়োগদানে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিদের মনোভাব ঠিক এই রকম—চার হাত-পা ও মানুষের অবয়ব থাকলেই চাকরির জন্য আমার লোকটি যোগ্য। কিন্তু আমার মতে, প্রজাতন্ত্রের নিম্ন গ্রেডের পদগুলোর দায়িত্বই বেশি। কারণ তাদের হাতেই থাকে প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও যানবাহন দেখাশোনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব। কোনো সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে দেখেছি অশুভ সিন্ডিকেটের দৌড়ঝাঁপ। এই সিন্ডিকেটের চাপে আমরা শিক্ষিত মানুষই খাল কেটে কর্মক্ষেত্রে কুমির আনছি। কীভাবে? বিষয়টি নিম্নলিখিত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যাবে।

প্রথম ঘটনাটি কোনো এক জেলার কর্তাব্যক্তির চাকরিজীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তিনি তার ক্ষমতাবলে নিয়োগ দিলেন এক সুন্দরী মহিলা সহকারীকে। এর পরের ঘটনা দেশবাসী সবাই জানেন। কর্তাব্যক্তির জীবনের সমস্ত অর্জন এক মুহূর্তে ধুলায় মিশে গিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি সাম্প্রতিককালে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা। উক্ত কর্মকর্তার ব্যাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি যায়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চোর শনাক্ত হয়। জানা যায়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জড়িত। চুরির দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উক্ত কর্মচারী প্রতিহিংসার বশে রাতের আঁধারে ঐ কর্মকর্তার বাড়িতে ঢুকে তাকে নির্মমভাবে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন। তিনি এখন মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিত্সাধীন আছেন। এখন প্রশ্ন, এমন চৌর্যমনোবৃত্তির মানুষ কীভাবে সেখানে নিয়োগ পেল? নিশ্চয়ই আমাদের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিই হয়তো কোনো সিন্ডিকেটের চাপে এমন লোকের নিয়োগ দিয়ে গেছেন। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে অন্য আরেকজন শিক্ষিত ব্যক্তিকে। তৃতীয় ঘটনা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। খবরে প্রকাশ, এ নিয়ে চার বছরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে দুই শতাধিক কম্পিউটার চুরির ঘটনা ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০ থেকে ২৭ জুলাই ২০২০ চতুর্থবার ৯১টি কম্পিউটার চুরি হয়েছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন নিরাপত্তা প্রহরীর মধ্যে ২০ জন কোনো কারণ না জানিয়েই ২৩ জুলাই থেকে অনুপস্থিত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কর্তাব্যক্তিদের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কারণ এসব লোকের পেছনে আছে অদৃশ্য শক্তি।

আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ কমিটির বহিঃসদস্য হিসেবে গিয়ে দেখলাম, রান্নার জন্য যে বাবুর্চি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি আবার নিজেই এক মহিলা ও একটি ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি সকালে আসেন আর সারা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান দিকে ঘোরাঘুরি করেন। সেখানে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বাগানের এক মালিকে দেখলাম। তার আবার দুটি মোটরসাইকেল। একটি লাল ও একটি কালো। তিনিও মালির কাজে নামমাত্র নিয়োজিত। তার মূল কাজ বিভিন্ন বিষয়ে তদবির করা। অনেক সময় দেখা যায়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ দেন। এমনও দেখেছি, জীবনে কখনো প্যান্ট বা জুতা পরেনি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির আত্মীয় হওয়ায় এখন বহালতবিয়তে চাকরি করছেন। একটি বিষয় লক্ষণীয়, কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু নিজের পকেটের টাকায় আত্মীয়ের উপকার করেন না। আত্মীয়দের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গণ-আত্মীয় বানিয়ে সারা জীবন ভরণপোষণের দায়িত্ব জনগণের ওপর দিয়ে যান।

কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ কর্মকর্তা থাকলে ৯০ শতাংশ থাকে কর্মচারী। প্রকৃতপক্ষে কর্মচারীদের নিষ্ঠা, সততা ও বুদ্ধিমত্তা কোনো প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মূল নিয়ামক। তাই আমার প্রস্তাব, কর্মচারী নিয়োগে সরকার ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে আরো সতর্ক। নিয়োগের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, সততা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সঙ্গে রাখতে হবে মানসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা। কারণ মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিই নানান সন্ত্রাসী ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকের খবর, সরকারের কোনো এক বিভাগের ডিজির ড্রাইভার শতকোটি টাকার মালিক এবং প্রভাব খাটিয়ে ঐ অফিসে তিনি তার নিকটাত্মীয়দের চাকরি দিয়েছেন। মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগগুলো হলে নিঃসন্দেহে এমন অসুস্থ মানসিকতার কর্মচারী সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি পাবেন না। এতে কর্তাব্যক্তিরা থাকবেন সুরক্ষিত।

আমার বড় বোন জেলা সমবায় কর্মকর্তা অবস্থায় অবসরে গেছেন। স্বভাবগুণে তিনি অত্যন্ত সত্ ও একনিষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তার জীবনের একটি ঘটনা বলছি, কোনো এক উপজেলায় কাজ করার সময় তার পিওন মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে অফিসের এক কপি চাবি নিজের কাছে রেখে দিতেন। পিওন না এলে তিনি নিজেই অফিস খুলতেন। সরকারি চাকরিবিধি পরিবর্তনের সময় এসেছে। চারিত্রিক যে কোনো স্খলনের জন্য সোজা চাকরিচ্যুতি হওয়া জরুরি এবং এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া উচিত। এখানে কোনো মানবিকতা দেখানোর অবকাশ নেই। এই বিষয়গুলো সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বিবেচিত হলে তবেই ফিরবে কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ।

লেখক : ড. মো. নাছিম আখতার, অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর-১৭০৭


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025398731231689