শিল্পে অরুচি! শিল্পে অশুচি!

মনোয়ার রুবেল |

গত কয়েক বছর আগে এক চোর ধরা পড়ার ভিডিও দেখেছিলাম৷ চোরের নিরীহ আবদার ছিল, ‘ আমার ভুল হয়ে গেসে। আমাক খমা করে দেন।’ তার নাম ছিল সিদ্দিক। সিদ্দিক এখন সেলিব্রিটি। টুকটাক ইউটিউব নাটক করে৷  শুনেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদান অতিথি হয়ে যাচ্ছে! লোকজন তার ভিডিও দেখছে। তার হাজার হাজার ফলোয়ার। একজন সিঁধেলচোরের সামাজিক এ উত্থানকে কী বলা যায় তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের চিন্তার যথেষ্ট খোরাক আছে। তবে সমাজ সচেতনদের দৃষ্টি যে একেবারেই এড়িয়ে যায় তা কিন্তু নয়। এটা রুচির দুর্ভিক্ষ।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ হিরো আলমের উত্থান নিয়ে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন। মামুনুর রশীদের বক্তব্যের জবাবে পক্ষে বিপক্ষে ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে৷ বাঙালি প্রতিক্রিয়াশীল জাতি,  ফেসবুক তার উস্কানিতে গরম ছাই এর মতো।  সেই ছাইয়ে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছেন মামুনুর রশীদ।

তার বক্তব্যের সমালোচকদের একদল হচ্ছে টুকিটাকি নাট্যকার৷ সব পেশায় এমন পরশ্রীকাতর লোক থাকে যাদের কাজ ইনিয়ে বিনিয়ে চরিত্র হনন করা। কেউ একজন (নাট্যকার) মামুনুর রশীদের সরকার দলের প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্যের কথাও লিখছেন। হয়তো, সেই নাট্যকারের ধারণা, এতে মামুনুর রশীদের চরিত্র যথাযথ হনন হয়েছে! আসলেই কি সরকার দলের প্রতি বা কোনো দলের প্রতি আনুগত্যকে অপরাধ ধরা যথেচ্ছ স্বেচ্ছাচারি বিবেচনা নয়? মামুনুর রশীদ একজন জনপ্রিয় অভিনেতাই নন শুধু, তিনি একজন প্রতিবাদী সমাজ সচেতন মানুষও বটে। ঢাকার মঞ্চে তার নাটক মানে অনন্য প্রতিবাদী ভাষা। তার প্রতিবাদ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও।

মামুনুর রশীদের লেখা বিখ্যাত নাটক রাঢ়াং। নাটকের ভিলেন নওগাঁর বলিহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলী এবং শীতেষ ভট্টাচার্য গদাই। এরা আদিবাসীদের উৎপীড়ক ও হন্তারক। দেশে বিদেশে এই নাটকের সুবাদে হাতেম ও গদাই ব্যাপক পরিচিত ঘৃণ্য চরিত্র।  অথচ অনেকে জানেই না, সদ্য প্রয়াত হাতেম নওগাঁ আওয়ামী লীগের  নেতা ছিলেন। মামুনুর রশীদ চরিত্রাঙ্কনে দলমত বিবেচনা করার লোক নন সে তো জানা কথা৷ কিন্তু হিরো আলমকে হিরো ভেবে কিছু নাট্যকার মামুনুর রশীদের চরিত্রলেপনের যে চেষ্টা করছেন তা সুকর্ম হচ্ছে কি?

সমালোচকদের আরেকদল হচ্ছে আমজনতা? বাঙালি, যারা কোনো উৎসবে পার্বনে সুযোগ হলে বটবৃক্ষকে খুঁচিয়ে পরমানন্দ লাভ করেন। তাদের কোনো স্থায়ী শত্রু নাই৷ তাদের শত্রু খ্যাতিমান লোকেরা ও তাদের খ্যাতি।  তাদের স্থুলদাগে কথা হলো, হিরো আলম চোর নন, ডাকাত নন, দুর্ণীতিবাজ নন, তবে তাকে পছন্দ করা কেনো রুচির দুর্ভিক্ষ হবে? 

সত্যি বললে, ক্ষুধা মন্দায় ভোগা রুগীকে কাচ্চি বিরিয়ানির সুস্বাদের কথা শুনালেও একই যুক্তিই শুনতে হতো। রুচি দুর্ভিক্ষে ভোগা জাতি মামুনুর রশীদের মতো প্রথিতযশা নাট্যজনকে নমস্য ভেবে সমর্থন না দিয়ে টিকটক সেলিব্রিটি হিরো আলমকে সমর্থন দিবেন সেটাইতো প্রত্যাশিত ছিলো। নিজের প্রচেষ্টার প্রতি হিরো আলমের যে নিরলস লক্ষ্যভেদী শ্রম তা প্রশংসা না করে উপায় নেই। প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে এসে শত বঞ্চনা লাঞ্ছনা সয়েও টিকে থাকার সংগ্রামে হিরো আলম একটি উজ্বল ছবি৷ কিন্তু সে দাবীতে তার সৃষ্ট কর্ম শিল্প সাহিত্যের বিচারে মানোন্নত ঘোষণা করতে হবে তা তো নয়৷ চেষ্টা ও সৃষ্টি উভয় কালোত্তীর্ণ নাও হতে পারে৷ প্রান্তিক যুবক হিরো আলমের ব্যক্তি প্রচেষ্টার প্রতি কারো অসম্মান থাকার কথা নয়। 

রুচির দুর্ভিক্ষে হিরো আলম প্রতিকী নাম মাত্র। বইমেলায় ইউটিউবারের খিস্তি সমৃদ্ধ বইয়ের জন্য যখন উপচেপড়া ভিড় হয় সেটাও রুচির পতন। অপেশাদার টিকটকার যখন টিভি নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র দখল করে রাখে সেটাও রুচির পতন। 'খমা করে দেন' সিদ্দিক যখন প্রধান অতিথি হয় সেটাও রুচির পতন। সামগ্রিকভাবে আমরা সমগ্রজাতি রুচির দৈনতায় ভুগছি। 

তবে এই রুচির অধপতনে মূলধারার শিল্পীদের কি কোনো দায় নেই? মামুনুর রশীদকে এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের টিভি ও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে যা হচ্ছে তা হতে উত্তরণের কোনো চেষ্টা তাদের ছিলো না। নাট্যজনরা বিদেশি টিভি সিরিয়াল বন্ধ করার জন্য রাজপথেও দাঁড়িয়েছেন, বিদেশি সিনেমা মুক্তি বন্ধের দাবিতে মিছিল করেছেন। অনেকের মতো আমিও পত্রিকায় লিখেছিলাম, রাজপথে না দাঁড়িয়ে নাটকের মান ভালো করুন, সিনেমার মান ভালো করুন। বিদেশি সিরিয়াল বন্ধ হলেও নাটকের মান বাড়েনি। ফলে হিরো আলমরা বাজারে এসে পড়েছে। দর্শক ক্লান্তি হতে মুক্তি চেয়েছিলো। দর্শক জানে এর নাম হিরো আলম,  তবু তারা  দেখছে। কারণ এর বিকল্প বিনোদন মামুনুর রশীদ মহোদয়রা দিতে পারেননি। তাঁরা ভাবেননি৷ 

হিরো আলম একা তার কাজের প্রতি যতোটা পরিশ্রমী ছিলেন বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিজেদের প্রতি ততটা সৎ থাকলে আজ রুচির দুর্ভিক্ষের কথা শুনতে হতো না।  

আমরা টিভিতে ক্লান্তিকর টকশো আর নাচের অনুষ্ঠানই দেখেছি অনন্তকাল। সেকেলে ফরম্যাটে দেখছি ম্যাগাজিন ও গানের  অনুষ্ঠান। আঞ্চলিক ভাষায় নাটকের নামে ভাঁড়ামি দেখছি কয়েকযুগ। এখন হিরো আলম, ভাইরাল সিদ্দিক বা টিকটক 'ভাই'রা এসেছেন। দর্শক হিসেবে আমাদের জন্য শিল্পের মান কমেনি, বাড়েওনি। আগে টিভিতে শিক্ষিত অভিনেতাদের একঘেয়ে ভাঁড়ামি দেখতাম, এখন আনাড়ি আ-অভিনেতাদের ভাঁড়ামি দেখছি। জিনিসতো একই। 

তবু মানুষ তাদের দেখছে। কারণ নতুন চেহারা, নতুন বাচনভঙ্গি৷ মানুষ বিনোদন চায়। বিনোদন দিতে পারলে মানুষ পছন্দ করবেই। এজন্য মোল্লা মৌলভীরা তাদের ওয়াজে হিন্দি বাংলা গেয়ে মানুষ টানছেন। এখন গানের কনসার্টে লোক হয় না, ওয়াজে হয়।  কারণ সেখানে গানও শোনা যায়, ঈমানও রক্ষা হয়! দাড়িওয়ালা শিল্পীর মুখে গান দেখতে আনকোরা লাগে। আনকোরা জিনিস পাবলিক দেখতে পছন্দ করে। এজন্যই হিরো আলম ও মৌলভীদের গানসমৃদ্ধ ওয়াজে এতো ভিউ হয়। 

বিনোদন কি জিনিস মৌলভীরা বুঝে গিয়েছেন। কিন্তু বিনোদন জগতের নাট্যজনরা এখনো বুঝলেন না! 

লেখক : মনোয়ার রুবেল, কলামিস্ট 

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026350021362305