মানুষ সামাজিক জীব। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে আসছে। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করাই মানুষের ধর্ম। কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিছু সংখ্যক ব্যক্তি একত্রে সংঘবদ্ধ হলে সমাজের উদ্ভব ঘটে। সমাজ বলতে এমন এক জনসমষ্টিকে বোঝায়, যারা একটি সাধারণ ঐতিহ্য, প্রথা, জীবনপ্রণালি বা একটি সাধারণ সংস্কৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একইসঙ্গে বসবাস করে এবং একত্রে বসবাস করার ফলে একই মনোভাব প্রকাশ পায়। অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘যে মানুষ সমাজে বসবাস করে না, সে হয় পশু না হয় দেবতা।’
ম্যাকাইভার ও পেজ তাদের ‘সোসাইটি’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ‘সমাজ হলো আচার এবং কার্যপ্রণালি, কর্তৃত্ব এবং পারস্পরিক সাহায্য দ্বারা পরিচালিত।’ সমাজ বিজ্ঞানী গিডিংস বলেছেন, ‘সাধারণ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে উদ্দেশ্য করে যখন একদল ব্যক্তি একত্রিত বা সংঘবদ্ধ হয় এবং যখন পরস্পর আলাপ-আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদান করে, তখন তারা একটি সমাজ গঠন করে বলা যায়।’ সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ও কার্যকরী সংগঠন হলো পরিবার।
পরিবার একটি আদিম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মানুষ একা বসবাস করতে পারে না। সঙ্গকামী মানুষ স্বভাবতই পরস্পর মিলেমিশে একত্রে বসবাস করতে চায়। মানুষের এই আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি হলো পরিবার। পরিবারের ভিত্তি হলো জৈবিক প্রবাহ। কারণ নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সন্তান-সন্ততি জন্ম দান করে। নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ ও সন্তান বাৎসল্য তাদেরকে পারিবারিক জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করে। স্নেহ, মায়া-মমতা ও নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা পরিবারের ভিত্তি। পরিবারের বিকল্প চিন্তা করা যায় না। পরিবারভুক্ত হয়ে মানুষ অনন্তকাল ধরে বসবাস করে আসছে। পরিবার বলতে সেই সামাজিক ক্ষুদ্র সংস্থাকে বুঝায় যেখানে এক বা একাধিক পুরুষ তার বা তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও অন্যান্য পরিজন নিয়ে একত্রে বসবাস করে। অধ্যাপক আর এম ম্যাকাইভার পরিবারের সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, ‘পরিবার হলো ক্ষুদ্র ও স্থায়ী বর্গ, যার উদ্দেশ্য সন্তান-সন্ততির জন্মদান ও লালন পালন করা।’
পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। প্রত্যেক কাজের জন্যই সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। পরিকল্পিত পরিবারে আয় অনুযায়ী সন্তানের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে পরিবার গঠনের প্রচেষ্টা করা হয়। এ ধরনের পরিবারে আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবারের সদস্য সংখ্যা কতো হওয়া প্রয়োজন তা পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ পরিকল্পনার ভিত্তিতে গঠিত পরিবারকে পরিকল্পিত পরিবার বলে। পরিবারের সন্তানদের উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার ওপরই পরিবারের সুখ, শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে।
বাবা-মার সচেতন পরিকল্পনার মাধ্যমেই তা সম্ভব। এ ধরনের পরিবারেই মা ও সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আহার ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করা সম্ভব। একজন সুস্থ মায়ের গর্ভে সুস্থ সন্তান জন্ম নিতে পারে এবং জন্মের পর উপযুক্ত আদর যত্নে সুষ্ঠুভাবে লালিত পালিত হতে পারে। শিশুর শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পরিবার বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বলতে বয়স অনুয়ায়ী তার দেহের গঠন, ওজন ও উচ্চতাকে বোঝায়। শিশুর এই দৈহিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিকল্পিত পরিবারে ঘন ঘন সন্তান গ্রহণ করার পরিবর্তে পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। একজন সুস্থ মা-ই সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারেন। পরিকল্পিত পরিবারে সন্তানের সংখ্যা সীমিত থাকে বলে প্রত্যেকের জন্য চাহিদামতো সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা সহজ হয়। ফলে শিশুর শারীরিক বিকাশ যথাযথ হয়। সন্তান সংখ্যা সীমিত থাকায় পরিকল্পিত পরিবারের সন্তানরা বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয় যত্ন ও পরিচর্যা পায়। ফলে শিশুর সুস্থ জীবনযাপন সহজ হয়। শিশুর শারীরিক বিকাশে খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পিত পরিবারে শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা করা সহজ হয়।
বাবা-মা শিশুকে খেলনা সামগ্রী কিনে দিতে পারেন, পর্যাপ্ত সময় ও খেলায় উৎসাহ দিতে পারেন। পরিকল্পিত পরিবারে সকল ব্যাপারে সুব্যবস্থাপনা থাকে। তাই শিশুর অযত্ন ও অবহেলা হয় না এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। এ কারণে পরিকল্পিত পরিবারের শিশুরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা করা হয় বলে পরিকল্পিত পরিবারে শিশু অসুস্থ হলেও সহজেই চিকিৎসাসেবা পায়। মায়ের বয়স বিবেচনা করে পরিবার পরিকল্পনা করা হয় বলে পরিকল্পিত পরিবারে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুজন্মগ্রহণের সম্ভাবনা কম থাকে। কেনোনা, মা অধিক বয়সে সন্তান ধারণ করলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়, শিশুপ্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার সন্তান ধারণে মায়ের কম বয়সও মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিস্বরূপ।
বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিকাশের ফলে শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটে। মানসিক বিকাশ সুষ্ঠু হলে সে শিশু পরিবেশের সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে ও নিরাপদ বোধ করে। ফলে শিশুর বুদ্ধিমত্তা, চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির সুষ্ঠুবিকাশ ঘটে। পরিবারের সুখ, শান্তি, সাফল্য ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে হলে অবশ্যই পরিকল্পিত পরিবারের প্রয়োজন।
পরিকল্পিত পরিবারের পরিবেশ শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। এ ধরনের পরিবারে সদস্যদের মধ্যে, বিশেষত বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে যা শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তান সংখ্যা সীমিত থাকায় পরিকল্পিত পরিবারের সন্তানরা বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয় যত্ন ও পরিচর্যা পায়। ফলে শিশুর সুস্থ জীবনাযাপন সহজ হয়। পরিকল্পিত পরিবারের শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা সহজ হয়। উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক। পরিকল্পিত পরিবারে প্রয়োজনীয় চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। ফলে শিশু মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকে। পরিকল্পিত পরিবারে বাবা-মা ও শিশুর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং জীবন-বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে। পরিকল্পিত পরিবারের পারিবারিক উৎসাহ শিশুদের সৃজনশীল কাজ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সহায়ক হয়।
কতকগুলো কারণে পরিবার যখন তার স্বাভাবিক কাজ সম্পন্ন করতে পরে না তখন পরিবার এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যাকে ভেঙে পড়া পরিবার বলে। যেমন পূর্বের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থাকা সত্ত্বেও স্বামী হয়ত নতুন করে বিয়ে করে নতুন সংসার গড়ে তোলে। এর ফলে পূর্বের পরিবার নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হয়। আবার স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যহ ঝগড়ার ফলে সন্তানরা স্বাভাবিক স্নেহ, মায়া-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনি-বনা না হওয়ায় স্বামী ও সন্তানকে রেখে স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যায়। ফলে পরিবারের সদস্য ও ছেলেমেয়েরা বিপদে পড়ে। আবার কোনো কোনো সময় দেখা যায়, অভাব-অভিযোগের কারণে স্বামী তার স্ত্রী ও সন্তানকে ফেলে অন্যত্র চলে যায়।
এসব কারণে ভেঙ্গে পড়া পরিবারের সৃষ্টি হয়।
এ ধরনের পরিবারে উপযুক্ত সেবা ও যত্নের অভাবে যে সন্তান বড় হয় সে কখনও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। শারীরিকভাবে এ সমস্ত সন্তান দুর্বল থাকায় তারা দেশের বা জনগণের কোনো উপকারে আসে না বরং তারা পরিবার ও দেশের বোঝাস্বরূপ। তাছাড়া অযত্ন ও অবহেলায় লালিতপালিত সন্তান মানসিকভাবেও অপরিপক্ক থাকে। পরিবারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা স্বেচ্ছাচারি হয়। নানাবিধ অপকর্ম ও কুকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে বৃহত্তর অপরাধের দিকে পা বাড়ায় এবং এক সময় নিজের ও পরিবারের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক: এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়