শৈশব থেকেই পরীক্ষার চাপ নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পরীক্ষা শব্দটাই আমার কাছে কিছুটা ভীতিকর বলে মনে হয়। কারণ পরীক্ষার আগের রাত-দিনগুলোতে এক ধরণের মানসিক দুশ্চিন্তায় সময় কাটে ছাত্র-ছাত্রীদের। কয়েকটা উন্নত দেশের কথা পড়েছি যেখানে দশ বছরের আগে নাকি কোন পরীক্ষা দিতে হয় না। আমার জানতে ইচ্ছে করে তাদের শৈশবটা কেমন হয়। নিশ্চয়ই খুব আনন্দের।

পরীক্ষা দিতে হবে না মানে পড়তে হবে কিন্তু শিখতে হবে না তা কিন্তু নয়। কারণ বই পড়া ছাড়াও শেখার আরও অনেক উপায় রয়েছে। আজকাল সেসব বিষয়ের উপরই গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সেগুলোকে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বলা হচ্ছে। কিন্তু শেখার মূল বিষয়টা পাঠ্য বই এবং পরীক্ষায় ভাল ফলাফলেই আটকে আছে। একটা মেয়ে যদি গণিতে ভাল করে কিন্তু ইংরেজীতে ভাল না করে সেক্ষেত্রে সে ঐ বিশেষ বিষয়ে দুর্বল কিন্তু কোনক্রমেই সে সার্বিকভাবে খারাপ নয়।

সব বিষয়েই দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। কেউ ভালো দৌড়ায়, কেউ ভাল গান করে, কেউ আবৃত্তি করে, কেউ বা নাচে আবার কারও একাডেমিক দিক শক্তিশালী। পরীক্ষা মানেই চ্যালেঞ্জ। টিকে থাকার যুগে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। তা হোক সে একাডেমিক বা হোক সে চাকরির বাজারের। পরীক্ষার হাত থেকে যেন নিস্তার মেলে না। পরীক্ষা মানেই টেনশন। ঘুমের ভেতর পরীক্ষার টেনশন, খাওয়ার টেবিলে টেনশন।

একাডেমিক পরীক্ষা শুরু হয় সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। সারা বছর এখন পরীক্ষা থাকে। সাপ্তাহিক, মাসিক, অর্ধবার্ষিক, বার্ষিক এছাড়াও ক্লাসে তো নিয়মিতই পরীক্ষা নেওয়া হয়। সারা দেশব্যাপী হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেনের বেশিরভাগই পরীক্ষা বিষয়টাকেই তাদের কিন্ডারগার্টেনের অন্যতম ভাল বৈশিষ্ট্য হিসেবে টানে। কে কত বেশি পরীক্ষা নেয় সেটা নিয়ে খোদ অভিভাবকদের মধ্যেও দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। কোন কোচিং বা কিন্ডারগার্টেনে কত বেশি পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং তার পদ্ধতি কীরূপ এসব নিয়েই ভালোমন্দ যাচাই করা হয়।

পরীক্ষা বিষয়ের সাথে মূল্যায়ন কৌশলটাকে তাই অনেকেই গুলিয়ে ফেলে। কোচিং সেন্টারগুলোতেই তাই সারা বছর পরীক্ষার চাপ থাকে। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেয় ঠিকই তবে তা আনন্দের সাথে না। পরীক্ষা শব্দটার সাথের রয়েছে মূল্যায়ন প্রসঙ্গ। কেননা মূল্যায়নের উদ্দেশ্যেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। কে কত ভাল করে ক্লাস করেছে, কতটা মনোযোগ সহকারে ক্লাসে শিক্ষকের কথা শুনেছে, কার মেধা কতটুকু এসব আর কি।

এসব মূল্যায়নের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলো নম্বর প্রদান। যে যত বেশি নম্বর পায় সে তত ভাল ছাত্র বলে বিবেচিত হয়। নম্বর কম হলে সে খারাপ ছাত্র। পরীক্ষায় ফেল করলে তো কথাই নেই। মানে পরীক্ষা মানেই পাশ আর ফেল। এত এত পাশ ফেলের চাপ সামলাতে না পেরে প্রতি বছরই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বের হবার পর অভিমানে বা লজ্জায় আত্মহত্যার মত বেদনাদায়ক সংবাদ শুনতে হয়।

পরীক্ষার দিনগুলোও আসলে ভয়ংকর। পরীক্ষার আগে দুঃস্বপ্ন দেখেনা এরকম মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। এসব স্বপ্নও আবার বিচিত্র। কেউ দেখে পরীক্ষার হলে গিয়েছে প্রশ্ন পেয়েছে কিন্তু একটাও কমন পরেনি। আবার কেউ দেখে পরীক্ষার হলে সব প্রশ্নের উত্তর সে পারে কিন্তু লিখতে পারছে না। এতসব ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে একাডেমিক পরীক্ষা জীবন পার করতে হয়। এরপর আবার চাকরির বাজারে পরীক্ষা শুরু হয়। ততদিনে পরীক্ষা সিনড্রোম অনেকটা কমে আসে। খুব ছোট ছোট এসব ছাত্র-ছাত্রী যখন কেউ ভাল ফল করে তখন অভিভাবক এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণামূলক এবং উৎসাহব্যাঞ্জক কথা বলে। তারা মনে মনে আনন্দিত হয়। আবার যদি কেউ খারাপ ফল করে তখন তাকে বিপরীতে বেশ কটু কথা শুনতে হয়।

এই দুই শ্রেণির ছেলেমেয়ের মধ্যে মিলটা হলো তারা উভয়ই এই ফলাফলের সুদূরপ্রসারী যে প্রভাব তা সম্পর্কে বোঝে না। তাদের কাছে জিপিএ ফাইভ মানেই ভাল এবং ফেল বা পয়েন্ট কম পেলেই খুব খারাপ কিছু। এই বদ্ধ ধারণা নিয়ে তারা বড় হতে থাকে। এবং তারপর যখন আবার জেএসসি পরীক্ষায় যায় পূর্ববর্তী ফলাফলের চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়ায়। এর বছর দুয়েক পরেই এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয়। সেই শিশু শ্রেণি থেকে ভর্তি হয়েই অবুঝ ছেলেমেয়েগুলো অল্প অল্প করে পরীক্ষা বিষয়টা যখন স্বল্প পরিসরে বুঝতে আরম্ভ করে তখনই এদের পাবলিক পরীক্ষার মত বড় আসরে বসতে হয়। তাদের মাথায় ঢুকে যায় ভাল ফলের স্বপ্ন। অনেক সময় নিজের দক্ষতার সাথে অভিভাবকের চাহিদা না মেলায় সন্তান মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। কেননা বেশিরভাগ অভিভাবকই চায় সন্তানের খুব ভাল রেজাল্ট।

বাধ্যবাধকতা শব্দটি আমি ব্যবহার করছি কারণ যে কোন ফলাফলেই চলবে এমন অভিভাবক আজ আর দেখা যায় না। তাতে তার সন্তানের মানসিক যন্ত্রণা যাই হোক না কেন। সবাই তো ভাল ছাত্র হয়ে জন্ম নেয় না। সবাই ক্লাসে এক রোল করে না। আবার পেছনের সারিতে থাকা ছাত্র বা ছাত্রীটির যে ভাল কোন পজিশনে যাবে না এমন কোন কথা নেই। এটা হচ্ছে মেধার বিষয়। মেধা হলো নিয়মিত চর্চার বিষয়। কিন্তু পরীক্ষা থেকে যে ভীতির জন্ম নেয় সেই ভীতি কাটতে কাটতে অনেকটা সময় লেগে যায়। আমার মনে হয় এখন জেএসসি পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। এই পরীক্ষাটি ইতোমধ্যেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হস্তান্তর করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার পর মাত্র দুই বছরের মাথায় আর একটি পাবলিক পরীক্ষার ঝক্কি এবং তার দু’বছর পর আবার একটা পাবলিক পরীক্ষা এভাবে একের পর এক পরীক্ষা দিতে দিতে আমাদের সন্তানরা পরীক্ষা বিষয়টির প্রতিই না বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে।

শিক্ষার্থীর অগ্রগতি মূল্যায়ন করার জন্য অবশ্যই পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু সেটা এত ঘন ঘন বা অল্প সময়ের ব্যবধানে না হওয়া উত্তম বলে মনে করি। তবে এর যদি কোন বিকল্প পদ্ধতি বের করা যায় তাহলেও হয়। অন্তত আমাদের সন্তানদের পরীক্ষাভীতি থেকে মুক্ত করতে চাইছি। ওরা যেন পরীক্ষা দিতে কোন ভয় না পায়। শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রমের একটি অপরিহার্য অংশ হলো পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোভাব অব্যশই ইতিবাচক হতে হবে। ইতিবাচক মনোভাব ছাড়া পরীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

অলোক আচার্য্য: শিক্ষক ও সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028178691864014