ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' হয় তবে সরকারি বিএল কলেজ 'দক্ষিণ বাংলার ট্রিনিটি'। কলেজটি ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবশেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়। দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী, পি ত, শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে এই বিদ্যায়তনে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এমন কলেজে ভর্তি হতে পারা যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য গর্বের বিষয়। বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ভৈরব নদের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে ব্রজলাল শাস্ত্রী প্রতিষ্ঠিত ও দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসীনের সৈয়দপুর ট্রাস্টের দান করা ৪০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটি আমাদের সময় সাজানো-গোছানো ছিল। যদিও এখন বিক্ষিপ্তভাবে ভবন নির্মাণ করায় সৌন্দর্যহানি ঘটেছে।
১৯৭৮ সালে মফস্বলের একটি স্কুল হতে এসএসসি পাসের পর অভিভাবকদের ইচ্ছা পূরণ করতে সরকারি বিএল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী ও উচ্চতর ক্লাসের ছাত্রদের পরামর্শে চতুর্থ বিষয় হিসেবে নিই গণিত।
সে সময় গণিতের ক্লাস হতো গ্যারেজের পশ্চিম পাশে (এখন সেটি পরিত্যক্ত) একটি টিনের ভবনে। প্রথম দিনের গণিতের ক্লাস। রুটিনে স্যারের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে 'এইচআর'। ক্লাসে পেছনের দিকে বেঞ্চে কোনোরকমে জায়গা করে নিয়েছি। ছাত্ররা বলাবলি করছে, এখন যে স্যার ক্লাস নেবেন তিনি গণিতের ওপর বই লিখেছেন এবং সেটি আমাদের পাঠ্য। যাহোক ক্লাসের ঘণ্টা বাজতেই দেখলাম- ব্যাকব্রাশ, জামা 'ইন' করা মাঝারি আকৃতির সৌম্য দর্শন এক ভদ্রলোক ক্লাসে প্রবেশ করলেন। ক্লাসে ঢুকেই নিজের পরিচয় দিলেন এবং 'অ্যালজেবরা' কী, এর ইতিহাস, উৎপত্তি, অবদান ইত্যাদি নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। যেমন কণ্ঠ, তেমন বাচনভঙ্গি। পিনপতন নিস্তব্ধতা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি আর শুনছি। ক্লাস শেষের ঘণ্টা বাজল। তিনি দৃপ্ত পায়ে রওয়ানা হলেন। তিনিই আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ।
এরপর তার অনেক ক্লাস করেছি। গণিতের প্রতি আমার আগ্রহ কতটুকু বেড়েছে জানি না, তবে তার প্রতি শ্রদ্ধা বড়েছে বহুগুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন গণিতের অনেক ক্লাস করেছি কিন্তু হারুন স্যারের মতো করে পড়াতে আমি কাউকে দেখিনি। গণিত শিক্ষা এবং এর প্রচার ও প্রসারে স্যারের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। একদিন স্যারের বাসায় গেলে তিনি আমাকে বললেন, 'তোমার মেয়ের কি গণিত বিষয় রয়েছে?' আমি বললাম, 'হাঁ স্যার।' তিনি উঠে বাসার ভেতরে গিয়ে আমার মেয়ের জন্য তার নিজের লেখা গণিতবিষয়ক বেশ কয়েকটি বই দিয়ে বললেন, 'তোমার মেয়েকে এগুলো পড়তে বলো।' আমি অভিভূত, বইগুলো পেয়ে আমার মেয়ে সোমাইয়াও খুব খুশি। বলেছিল, 'তোমার স্যার কী করে জানলেন যে এ বইগুলো আমার ভালো লাগবে?'
আমি 'বি' গ্রুপে ছিলাম। স্যারের ছেলে তাপস আমাদেরই ক্লাসের 'এ' গ্রুপে। একসঙ্গে পড়লেও গ্রুপভিন্নতার কারণে তাপসের সঙ্গে তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি। এইচএসসির পর আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তাপস বুয়েটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ হতেই বিসিএস দিয়ে চাকরি পেয়েছি। অনেক দূরে পোস্টিং, সেই সুনামগঞ্জে। ছুটি পেলেই খুলনা আসি। তাপস সে সময় পিডিবির ইঞ্জিনিয়ার। আমার বন্ধু একই গ্রুপের ছাত্র শামীমও পিডিবি খুলনাতে চাকরি করে। খুলনা গেলেই শামীমের বাসা আর অফিসে আমাদের আড্ডা। মাঝেমধ্যে আড্ডায় তাপস থাকত। তখন বরং তাপসের সঙ্গে সখ্য বাড়তে থাকে। এরপর খুলনায় এডিসি হিসেবে আমার পোস্টিং হলে সে সখ্য আরও নিবিড় হয়েছে।
আমি তখন গোপালগঞ্জের ডিসি। তাপস একদিন আমাকে টেলিফোনে বললো, 'বিএল কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন হয়েছে। আব্বা তোকে সদস্য হতে বলেছেন।' ২০১০ সালের নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর মাসের কোনো একদিনে খুলনা সিটি ল' কলেজে আমরা ক'জন প্রাক্তন ছাত্র ফরম পূরণ করি। হারুন স্যার বিএল কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। বস্তুত তিনি ছিলেন এর নিউক্লিয়াস। অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে এটিকে একটি বিশাল সংগঠনে পরিণত করেছেন।
হারুন স্যারের নেতৃত্বে ২০১১ সালের ২৪-২৫ ডিসেম্বর বিএল কলেজ ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম পুনর্মিলনী। বর্ণিল সাজে সেজেছিল কলেজ ক্যাম্পাস। শোভাযাত্রা শেষে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। আমি, তাপস, মিল্লাদ, শোয়েব, আহাদ, শামীমসহ অনেকে সেদিন একত্র হয়েছিলাম। শামীম সুদূর সিডনি থেকে এসেছিল শুধু এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ, নদীর ধারে হেঁটে বেড়ানো, স্মৃতিচারণ, ক্লাসরুম দর্শন, মধ্যাহ্নভোজ- সবকিছু আমরা সকলে মিলে উপভোগ করেছি। কী অসাধারণ দক্ষতায় হারুন স্যার অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিলেন!
অধ্যাপক হারুনুর রশীদ একজন সদালাপী, অমায়িক, আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ, সংস্কারবিহীন একজন মানুষ। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। গণিত বিষয়ে পাঠ্যবই রচনা ছাড়াও গণিতের ইতিহাস, মজার মজার বিশ্নেষণ নিয়ে অনেক বই লিখেছেন। কোনো কোনো বই এতই সুখপাঠ্য যে, পড়া শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। তার লেখা 'উনিশ ও বিশ শতকে খুলনা নগরী' নামক বইটি পড়লে খুবই অল্প সময়ে খুলনার ইতিহাস জানা যায়। কী অসাধারণ লেখার ক্ষমতা!
আমি গর্ব অনুভব করি এমন একজন মহান ব্যক্তি আমার শিক্ষক ছিলেন। এখনও আমি খুলনায় গেলে তার সান্নিধ্য পেতে চেষ্টা করি। কী করে সৎ থাকতে হয় সেটি তাকে দেখলেই বোঝা যায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এটি শুধু অনুশীলন করেন না, পরিবারের সবাইকে অনুশীলন করতে বাধ্য করেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও তিনি এক কীর্তিমান তরুণ। হারুন স্যার দীর্ঘজীবন লাভ করে অনেকদিন আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন, এ কামনা করি।
লেখক : শেখ ইউসুফ হারুন, সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়;
বিএল কলেজের এইচএসসি, ১৯৮০ ব্যাচের ছাত্র