সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়

মো. তারিকুল ইসলাম |

আত্মহত্যা বলতে আমরা বুঝি যখন কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয় বা নিজেই নিজের মাধ্যমে প্রাণনাশ ঘটায়। বর্তমান সমাজে এই ব্যাধিটি যে প্রকট আকার ধারণ করছে তা আমরা সামপ্রতিক কয়েকটা ঘটনা দেখলেই বুঝতে পারব। ২০১০ সালের সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালের একটা জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতিবছর প্রতি লাখে প্রায় ১২৯ জন মানুষ আত্মহত্যার শিকার হয়। এদের মধ্যে ৮৯ শতাংশই আবার নারী। আত্মহত্যার প্রকটতা ১৫-২৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। গত ৪-৫ বছরে এটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। শুধু ২০১২-১৬ সালে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। গত দুই-তিন বছরের মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮-১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার শিকার হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আত্মহত্যার দিক থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে।

আত্মহত্যার যে কারণগুলো সবার আগে আসে সেগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা দরকার। সমাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এর জন্য বেশি দায়ী। আত্মহত্যার শিকার অধিকাংশই ছাত্রছাত্রী। একটি ছেলে বা মেয়ে যখন পড়াশুনা করে সমাজ তার প্রতি অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সমাজের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিছু মানুষ ব্যতীত সবাই পূরণ করতে পারে না..। সমাজ বা পরিবার শুধু সফলতাই খুঁজে। সমাজের এই যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে আজকের তরুণ সমাজ। কখনো কখনো বেছে নেয় মৃত্যুর মতো কঠিন পথ।

প্রেমঘটিত কারণ থেকেও ঘটছে এমন ঘটনা। তথ্য প্রযুক্তি আর যুগের বিপ্লবের ফলে প্রেম আজ যেন এক হাতের পুতুল, যার ফলে ১৪-১৫ বছরের কিশোর-কিশোরীরা প্রেমে জড়িয়ে পড়ছে খুব সহজেই। আবার এই সস্তা প্রেমের অবসানটাও খুব সস্তাভাবেই হচ্ছে। সব ক্ষেত্রে না ঘটলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই চিত্রই প্রতিফলিত হয়। প্রেমের বিচ্ছেদের পর কিশোর বয়সের অনেকেই ঠুনকো আবেগের শিকার হয়ে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়।

বেকারত্ব আর হতাশাও একজনকে নিয়ে যেতে পারে আত্মহত্যার দুয়ারে। শিক্ষাজীবন শেষে সকল শিক্ষার্থীর একটা স্বপ্ন থাকে সোনার হরিণ তথা একটা চাকরি। কিন্তু প্রতিযোগিতার এই বাজারে নিজেকে সফল প্রমাণ করা খুব একটা সহজ হয় না সবার জন্য। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি না পাওয়া ও মানসিক হতাশা এবং পরিবারের চাপের ফলেও অনেক মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিচ্ছে আজকের তরুণ সমাজ। একাকীত্ব আর মানসিক অবসাদের মাধ্যমেও আত্মহত্যার শিকার হচ্ছে এমন ঘটনা এখন অহরহ দেখা যায়। যারা মূলত একাকীত্ব নামক যন্ত্রণায় ভোগে, তাদের ক্ষেত্রে এর হার অনেক বেশি দেখা যায়। যখন কেউ একা একা থাকে, বাইরের জগতের সঙ্গে কম মিশে। তাদের মধ্যে একধরনের মানসিক হতাশা দেখা দেয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাকে ভাবায়। হতাশা আর একাকীত্ব একসময় তাকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়।

কারো মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েও কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যখন কেউ আত্মহত্যা করে এর মাধ্যমে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষজন প্রভাবিত হয়। যারা মূলত আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের ভালো-মন্দ বিচার ক্ষমতা কমে যায়। তারা প্রভাবিত হয় যে আত্মহত্যার মাধ্যমেই এ সমস্যা দূর করা সম্ভব। যৌন নির্যাতন ও ইভটিজিং যেটা মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশি ঘটে। এটিও সমাজের একটি অন্যতম ব্যাধি। মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই এর শিকার হলে পরিবারের সঙ্গে এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে না বা এর সমাধান করতে পারে না। যার ফলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মাদকদ্রব্যও আত্মহত্যার কারণ হতে পারে। মাদকদ্রব্য সেবন বা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। যার ফলে মাদকদ্রব্য সেবন বা গ্রহণকারীরা এক ধরনের ঝুঁকির অবস্থানে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এম বি এ করে আত্মহত্যা, ফিন্যান্স বিভাগের তরুণের আত্মহত্যা, ঢাবির ছাত্রের ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা, ঢাবির মেয়ের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা। চাকরি না পেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যা আমাদের অনুভূতিতে নাড়া দেয়। এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের আগামী প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে।

এর জন্য সচেতনতা বাড়িয়ে তুলতে হবে নিজ পরিবার থেকে। পরিবারের অভিভাবকদের উচিত তার ছেলেমেয়ের সকল সুবিধা-অসুবিধা আলোচনা করা। পরিবারকে বেশি বেশি সময় দেওয়া। আমাদের প্রতি সমাজের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তা দূর করতে হবে। প্রেমঘটিত যেকোনো ব্যাপার বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া। দরকার হলে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করা। পড়ালেখার পরে বেকার না থেকে শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়ে ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলা। বর্তমান সরকার এই ব্যাপার নিয়ে নানা কাজ করে যাচ্ছে, ট্রেনিং থেকে শুরু করে লোনের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে সরকার। মুখ বন্ধ করে রাখলেই এ সমাজ আপনাকে বাঁচতে দিবে না। তাই মুখ খুলতে হবে, আর এর প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের প্রত্যেকটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সেবা চালু করা উচিত। এমনকি স্কুল পর্যায়ে এই ধরনের সেবা থাকা উচিত। আত্মহত্যা কোনোকিছুর সমাধান হতে পারে না। জীবনটাই তো সংগ্রামের সেখানে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। সেখানে একটি মাত্র জীবনে অল্পতেই যদি কেউ হেরে যায় আত্মহত্যার কাছে, তাহলে জীবনের মানে কি। সচেতনতা গড়ে উঠুক নিজ থেকেই।

 

লেখক:শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028119087219238