সংস্কৃত পড়াতে মুসলিম শিক্ষক, হিন্দু ছাত্রদের বিক্ষোভ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ভারতের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন মুসলিম যুবক সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর সেখানকার হিন্দু ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যায়ল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, সংস্কৃতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ফিরোজ খানের চেয়ে যোগ্যতর আর কোনও প্রার্থী ওই পদে ছিলেন না।

কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ফিরোজ খানকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে দিতে রাজি হচ্ছে না, উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে তারা অবস্থানও নিয়েছেন। প্রসঙ্গত, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ভারতে সংস্কৃত পড়তে বা পড়াতে পারবেন কি না তা নিয়ে দেশটিতে বিতর্ক অবশ্য অনেক পুরনো।

তবে এবারের এই বিতর্কে শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে বিজেপির এমপিরাও অনেকেই রাজস্থানের ফিরোজ খানের পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। বিখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে বিএ পাশ করে এমএ-তে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন, তখন তিনিও বাধার মুখে পড়েছিলেন।

তখন পন্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জেদ ধরে বসেন হিন্দু নন এমন কাউকে তিনি বেদ পড়াবেন না। এই বিতর্ক আদালতেও গড়ায়, পরে দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে ‘ভাষাতত্ত্ব’ নামে নতুন বিভাগ চালু করে সেখানে শহীদুল্লাহকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন তখনকার উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

সেই ঘটনার শতাধিক বছর পর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএইচইউ) অনেকটা একই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন জয়পুরের পাশের বগরু গ্রামের ফিরোজ খান।

গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিএইচইউর ছাত্রছাত্রীরা গান গেয়ে, বাজনা বাজিয়ে লাগাতার বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃত বিদ্যা ধর্ম বিজ্ঞান’ নামক সেন্টারে ফিরোজ খানকে সংস্কৃতের শিক্ষক হিসেবে মানা সম্ভব নয়।

আন্দোলনকারী ছাত্রদের একজন বলেন, ‘আমাদের সেন্টার একটি গুরুকুল। এর প্রবেশপথে প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালব্যজির যে বাণী শিলাতে লিপিবদ্ধ আছে তাতে স্পষ্ট লেখা আছে, হিন্দুদের চেয়ে ইতর এমন কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। তো সেখানে এই ব্যক্তি কীভাবে ঢুকবেন, কীভাবেই বা পড়াবেন?’

বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও উপাচার্য রাকেশ ভাটনগর অবশ্য এখনও দৃঢ়ভাবে ফিরোজ খানের পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। প্রক্টর রামনারায়ণ দ্বিবেদীও বলেন, ‘আমাদের নিয়োগ সমিতি সব নিয়মকানুন মেনেই এই মুসলিম অধ্যাপককে চাকরি দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা মানতে চাইছে না। আমি বলব এই ধরনের আন্দোলন তাদের করা উচিত নয়।’

ফিরোজ খান টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাদের পরিবারে সংস্কৃতের চর্চা আছে বহুকাল ধরে। তার বাবা রমজান খান ভজন গান করেন। এমনকি গোশালা রক্ষায় প্রচার পর্যন্ত চালান। ফলে তার বিরুদ্ধে এই ধরনের আন্দোলনে ফিরোজ খান স্বভাবতই অত্যন্ত ব্যথিত।

কলকাতায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক শিউলি ঘোষ বসু বিবিসিকে বলছিলেন, ‘বিএইচইউতে এ ধরনের আন্দোলন তাকে স্তম্ভিত করেছে। খুব খারাপ লাগছে। আমরা যারা সংস্কৃত পড়াশোনার সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য যেমন এটা অপমান, তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও অপমান বলেই আমি মনে করি।’

শিউলি ঘোষ আরও বলেন, ‘এটা আসলে একটা কুসংস্কার। কই, আমাদের বিভাগের বহু ছাত্রছাত্রীই তো হিন্দু নন, আর তারা সফলও হচ্ছেন, তাতে তো কোনওদিন সমস্যা হয়নি। আমার এক ছাত্রী জুবিন ইয়াসমিন গবেষণা শেষ করে এখন আশুতোষ কলেজে সংস্কৃত পড়াচ্ছে। কোনোদিন তো তাতে কোনও অসুবিধা হয়নি।’

তিনি জানালেন, ‘সাবের আলি নামে আমার এক পরিচিত অধ্যাপক আছেন, যিনি বারাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়ান। আমাদের এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্র জসিমউদ্দিন পড়াশোনায় দারুণ। কোথাও তো কিছু আটকাচ্ছে না।’ তিনি এর জন্য মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেছেন।

গুজরাটের বিজেপিদলীয় এমপি ও বলিউড অভিনেতা পরেশ রাওয়াল এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ভাষার সঙ্গে ধর্মের তো আসলে কোনো সম্পর্কা নাই।’ এই যুক্তি দিলে মোহম্মদ রফি যে কোনোদিন ভজন গাইতে পারতেন না বা নৌশাদ তাতে সুর দিতে পারতেন না, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

ব্লগার ও সাংবাদিক হর্ষবর্ধন ত্রিপাঠী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমি মনে করি গোটা দেশের ও বিশেষ করে ভারতের হিন্দুরাষ্ট্রবাদীদেরও উচিত ফিরোজ খানের নিয়োগে সমর্থন জানানো। কারণ মনে রাখবেন, আদালত তো এই সেদিনও বললো, হিন্দুত্ব আসলে একটি জীবনপদ্ধতি।’

ভারতে সংস্কৃতকে অনেকে ‘দেবভাষা’ বলে বর্ণনা করেন। অর্থাৎ হিন্দুদের দেবদেবীরা এই ভাষাতেই কথা বলেন বলে তাদের বিশ্বাস। কিন্তু সমস্যা বাঁধছে তখনই, যখন সেই ‘দেবভাষা’ পড়বার বা পড়ানোর অধিকারও অনেকে হিন্দু নন এমন ব্যক্তিকে দিতে রাজি নন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ - dainik shiksha চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার ৫ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সুখবর - dainik shiksha ৫ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সুখবর বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026059150695801