সঞ্চয় বাড়ানো ও উচ্চ শিক্ষার মান

স্বদেশ রায় |

নির্বাচনের আগেই সামনে এসেছিল, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে ও উচ্চ শিক্ষার মানের দিকে নজর দিতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ গঠন করার সময় শেখ হাসিনাও যে বিষয়টি মাথায় রেখেছেন তার প্রমাণ- তিনি দু’জন অভিজ্ঞ ও সফল মন্ত্রীকে অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল গত পাঁচ বছর পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে সফল। শেখ হাসিনার উচ্চাকাক্সক্ষার  অর্থনীতিকে তিনি সঠিকভাবে পাঁচ বছরে পরিকল্পনায় এনেছেন। তাই স্বাভাবিকই তার কাজের শুরুতে আশা করা যায়, শেখ হাসিনার উচ্চাকাক্সক্ষার অর্থনীতির বিকাশ তাঁর হাত দিয়ে ভালভাবেই ঘটবে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন তার মন্ত্রণালয় একটি গতিশীল মন্ত্রণালয় ছিল, তিনি সমুদ্র বিজয়ের মতো বড় বিজয়েরও একজন নায়ক। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সফল হবেন এই আশাই এখন দেশের নানান মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আশাবাদী পোস্ট আসছে। যেমন আসছে অর্থমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও।

দু’জনই অভিজ্ঞ মন্ত্রী। তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের কাজের তালিকায় কোন্টি বেশি প্রাধান্য পাবে সেটা ঠিক করে নিয়েই কাজ করবেন। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, গত দশ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নতি করলেও সব ক্ষেত্রে কিন্তু তাদের শতভাগ সফলতা নেই। গত দশ বছরে তেমনি সব মন্ত্রণালয়ে অসফলতার অনেক স্থান আছে। আশা করা যায়, প্রত্যেক মন্ত্রী তার নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাজের ক্ষেত্রে ওই মন্ত্রণালয়ে অসফলতার স্থান কোন্গুলো সেগুলো চিহ্নিত করে, সেই কাজগুলো আগে করবেন। যেমন আমাদের অর্থনীতির আকার বেড়েছে ঠিকই তার সঙ্গে অন্য অনেক কিছুর মিল থাকলেও সঞ্চয়ের মিল নেই। বিশেষ করে দেশের মানুষের অর্থ সঞ্চয়ে রূপান্তরিত হয়নি সঠিকভাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মানুষের হাতে অর্থ আসছে। মানুষ নানাভাবে অর্থ উপার্জন করছে। তবে সবাই সঞ্চয়ের ভেতর আসছে না। দেশের অর্থ উপার্জনকারী সব মানুষ সঞ্চয়ে এলে ওই দেশের অর্থনীতি প্রকৃত অর্থে আলাদা ধরনের শক্তিশালী হয়। দেশে সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি থাকলে দেশ যেমন টেকসই অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয় তেমনি সরকারও নিজ উদ্যোগে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা-ে হাত দিতে সাহসী হয়। তাই এ মুহূর্তে অন্য দশটি কাজের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষকে অধিক সঞ্চয়ের পথে আনা প্রয়োজন।

সঞ্চয়ের পথে আনতে হলে কী কী করতে হবে সেটা অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থমন্ত্রী সব থেকে ভাল বুঝবেন। তবে বাংলাদেশের উপার্জনকারী সব মানুষকে সঞ্চয়ের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, দেশে কৃষি ব্যাংকসহ মোট পাঁচটি বড় সরকারী ব্যাংক আছে। সরকারী ব্যাংক প্রাথমিকভাবে লাভের কথা চিন্তা না করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও বেশি শাখা খুলতে পারে। অর্থাৎ ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনে তারা সঞ্চয়ের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং চালু করতে পারেন। চালু করতে পারে নানা স্থানে ব্যাংকের ছোট ছোট উইন্ডো (অর্থাৎ তিন থেকে চার জন স্টাফের একটি শাখা)। এর পাশাপাশি বেসরকারী ব্যাংকগুলোর শাখা খোলার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি উদার হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে দ্রুত শাখা খোলার নির্দেশও দিতে পারে। অর্থাৎ একটা টার্গেট ঠিক করা দরকার, কীভাবে প্রতি বছরে কত সংখ্যক সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংক পৌঁছাবে। তবে ব্যাংকে সাধারণ মানুষের টাকা আনার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা গত পাঁচ বছরে সামনে এসেছে, সেটা সুদের হার। শিল্পায়নের লক্ষ্যে ব্যাংক শিল্প ঋণের সুদের হার ওয়ান ডিজিটে নামাতে গিয়ে সেভিংসের সুদের হার যেখানে চলে গেছে সেটা সাধারণ মানুষকে অনেকটা ব্যাংকবিমুখ করছে। এ বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সেভিংসের জন্য মানুষকে মোটামুটি একটু লাভজনক সুদ না দিলে সাধারণ মানুষকে ব্যাংকমুখী করা কষ্টকর। তাই একদিকে শিল্পায়ন অন্যদিকে দেশের সঞ্চয়- দুইয়ের ভেতর একটা সমন্বয় করা দরকার। সঞ্চয়ের জন্য কোন ধরনের ইনসেনটিভ দেয়া যেতে পারে সেটা খোঁজা দরকার। গত পাঁচ বছরে এটা শতভাগ সম্ভব হয়নি বলে মনে হয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই বলা হয়েছে, না বিষয়টি ঠিক আছে। তার পরেও নতুন অর্থমন্ত্রী যদি ব্যাংকারদের বক্তব্য এবং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ জনগণের কথা শোনেন তা হলে তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, বর্তমান সেভিংসের সুদের হারে শতভাগ মানুষকে ব্যাংকমুখী করা সম্ভব নয়। অথচ দেশকে উন্নত করতে, দেশের সব মানুষকে সঞ্চয়ের আওতায় আনার জন্য এখানে একটি সমাধান দরকার। নতুন অর্থমন্ত্রী শপথ নিয়েই বিডি নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন। তাই আশা করি, এটা তার কাছে কোন চ্যালেঞ্জই যেন না হয়। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে নরসিমা রাও ও মনমোহন সিং সফল হয়েছিলেন বেশি মাত্রায় উদার নীতি অবলম্বন করে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারত যখন উদার হলো তখন দেখা গেল বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছেও বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা কতখানি কার্যকর হবে বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়টি এখন সামনে এসেছে। অর্থনীতিকে নিয়ে আরও একটা লাফ দিতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়ানো দরকার, এ নিয়ে মনে হয় কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না।

অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যদি তার মন্ত্রণালয়ে গত দশ বছরে যেটা সঠিকভাবে সম্ভব হয়নি তা খুঁজতে যান- তাহলে প্রথমেই তাঁর চোখে পড়বে গত দশ বছরে দেশে শিক্ষার জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে ঠিকই- তবে দেশে উচ্চ শিক্ষার মান বাড়েনি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার মান নেমেছে। কোন বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না বলে বলা যায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষার মান ধরে রাখতে পারেনি। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, এই শিক্ষার মান নামা শুরু হয়েছে আরও আগে থেকে। বাস্তবে এখন প্রথমে প্রয়োজন কোন কোন কারণে উচ্চ শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে, গত দশ বছরে কেন এটা বন্ধ করা বা মান বাড়ানো সম্ভব হলো না- এর কারণগুলো খুঁজে বের করা। সে জন্য কোন কমিশন করার প্রয়োজন আছে কিনা বা দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার সেগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। একটি সার্বিক পরিকল্পনা নিয়ে দেশের উচ্চ শিক্ষার মানকে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর বাড়িয়ে অন্তত প্রথম ধাপে এশীয় উন্নত দেশগুলোর কাতারে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষার মান না বাড়লে বাস্তবে আমাদের অর্থনৈতিক জিডিপি একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যাবে। তাছাড়া আমরা যে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশের পথে রওনা দিয়েছি এবং ভবিষ্যতে উন্নত দেশ হব এটা আমাদের উচ্চ শিক্ষার মান বাড়ার পরেই সম্ভব হবে। বাস্তবে এখন সময় এসে গেছে এই মুহূর্ত থেকে প্রথমে এশীয় উন্নত দেশগুলোর মানের শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলা এবং ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলা। আমাদের অন্তত একটি রূপরেখা নেয়া দরকার, আগামী একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে যেন দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে। অদক্ষ শ্রমশক্তি বিক্রি থেকে ধীরে ধীরে দেশকে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি দেশের সকল কাজে মানসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিতদের নিয়োজিত করার বাস্তবতা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে সব পেশাতেই সত্যিকারে দক্ষ ও শিক্ষিতের সংখ্যা কম এটা স্বীকার করেই এগুতে হবে।

সূত্র : দৈনিক জনকন্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028970241546631