সঠিক শিক্ষাই পারে দুর্নীতি দূর করতে : বিদায়ী দুদক চেয়ারম্যান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের দিকেও আমার বরাবর নজর ছিল। বিশেষ করে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতে সুশিক্ষা দেওয়া হয়, এ নিয়ে আমি চিন্তা-ভাবনা করেছি এবং যথাসম্ভব তৎপর হয়েছি। শিক্ষকরা ঠিক সময়ে ক্লাসে যান কিনা, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সকালবেলা শ্রেণিকক্ষে হাজির হয়েছিলাম একাধিকবার। কোচিং বাণিজ্য, নোট-গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দিয়েছি। আমি চেয়েছি শিক্ষকরাই হবেন কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের গাইড। কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছি, আমরা আমাদের সন্তানদের (শিক্ষার্থী) আপনাদের কাছে আমানত রেখেছি। আমানতের খেয়ানত করবেন না। তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলুন। শিক্ষকরাই গাইড হয়ে শিক্ষার্থীদের আলোর পথে নিয়ে যেতে পারেন। এটাই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা।

আমি মনে করি, প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এক সময়ে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হবে। কারণ, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রছাত্রী যখন সরকারি-বেসরকারি খাতে চাকরি ও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে তখন দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না।

শিক্ষার্থীদের উত্তম চর্চা বিকাশে সারাদেশের চার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সততা স্টোর, ২৬-২৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সততা সংঘ গঠন করা হয়েছে। দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে সততা, নিষ্ঠাবোধ ও দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে তাদের মাঝে সততা সংঘ, সততা স্টোর, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কার্টুন প্রতিযোগিতা, সমাবেশসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

বস্তুত, আমরা স্কুলের শিশুদের মাঝে একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এই কাজটা হয়তো ১০ বছর পর দৃশ্যমান হবে। এই বাচ্চারা ব্যাংকে যাবে, চাকরি করবে, সরকারে আসবে। এরাই তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এটা এমন এক কাজ, যা দেখা যায় না সহসা। যখন শিশুরা পরিপকস্ফ হয়, পুরোনো কথা মনে আসে। যেমন একজন মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায় কিন্তু অ, আ, ক, খ, কবিতা 'আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই' ভোলে না। মনের ভেতরে এই গেঁথে যাওয়ার বিষয় সেটা আমরা শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যতক্ষণ পর্যন্ত এই জাতি প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের সত্যিকার শিক্ষা না দিতে পারবে ততক্ষণ দুর্নীতি এ সমাজ থেকে যাবে না; দুর্নীতির মাত্রা কমবে না। সে জন্য আমি সবসময় আমার চাকরিজীবনে চেষ্টা করেছি প্রাইমারি ও হাই স্কুলের দিকে নজর দেওয়ার।

আমি এক সময় বলেছিলাম এবং এখনও বিশ্বাস করি, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের জন্য। সহকারী শিক্ষকরা সহকারী কমিশনারের মতো নিয়োগ হবে। তখন দেখা যাবে, আমার দেশের চেহারা পাল্টে গেছে। মানুষ মানুষে পরিণত হচ্ছে। প্রাইমারি স্কুল ঠিক হলে হাই স্কুল ঠিক হয়ে যাবে। উচ্চশিক্ষিতদের হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে চাই না। কলেজের কথাও বলছি না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়; এ দুটো জায়গায় হাত দিলেই কলেজে হাত দিতে হবে না। সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক হয়ে যাবে।

শিশুরা এখনও রাজনীতি বোঝে না, অর্থনীতি বোঝে না। ওরা কিন্তু এইটা বোঝে- দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। এইটা ভালো, এইটা মন্দ ইত্যাদি। হ্যাঁ, টিনএজারদের একটা আবেগ থাকে। এটা আমরা চাই। ওদের ইমোশন থাকবে, দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের খেলা হয়, দেশের পক্ষে একজন বয়স্ক মানুষ যতটুকু উত্তেজিত হন, তখন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তার চেয়ে ১০ গুণ উত্তেজিত হয়। তাদের আবেগটা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। এর তুলনা হয় না। যখন খেলা হয়, শিশুরা দেখে দেশের পতাকা উড়ছে, তখন তাদের যে উত্তেজনা- একটা স্কুল ছুটি হলে যা হয়।

আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভালো দৃশ্য হচ্ছে স্কুল ছুটির সময় শিশুদের বের হওয়া। স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের যে কলকাকলি, তাদের যে উত্তেজনা; যে পবিত্রতা নিয়ে তারা বের হয়ে আসে মুক্ত আকাশের নিচে; এর চেয়ে কোনো ভালো দৃশ্য আর আমি দেখিনি। এই দৃশ্য শুধু যে এই দেশে হয়, তা নয়। এ দৃশ্য দেখেছি বিশ্বব্যাপী। চাকরিজীবনে আমি ৭০-৮০টি দেশে গিয়েছি। বিভিন্ন দেশে আমি কাজের ফাঁকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতাম। সেখানেও একই দৃশ্য। এ শিশুরাই কিন্তু আগামীতে পৃথিবীর ভার বহন করবে। তারা একই সুতায় গাঁথা।

এ জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নীতিমালায় স্কুলের শিশুদের নিয়ে বেশি কথা বলা আছে। এর মূলকথা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা এক সময় থাকব না। শিশুরা থেকে যাবে। যখন একটা রাস্তা করা হয়, চিন্তা করতে হয়- এই রাস্তায় আজ আমি হাঁটছি, কালকে হাঁটব না। পরের প্রজন্ম হাঁটবে। তাই রাস্তাটা সুন্দর করা দরকার। এটাই হলো 'সাসটেইন্যাবিলিটি'। প্রতিবেশ সুরক্ষায় আমরা বলি, পশু-পাখি মারা যাবে না। এরা মারা গেলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অসুবিধায় পড়বে। এই বিশ্বের সৌন্দর্য তারা দেখতে পাবে না। এ জন্য 'কোয়ালিটি এডুকেশন' ও মাতৃমঙ্গলের কথা বলা হয়। কেন বলা হয়? কেন শিশুমৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহারের কথা বলা হয়? উন্নয়নের কথা বলা হয়? বলা হয় এই জন্য, কারও একটা সন্তান যদি মারা যায়। শিশু যখন ৫ বছরের আগে মারা যায়, তখন মা-বাবা চান আরও বাচ্চা। আগের প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা এমনই ছিল। আমরা আট ভাইবোন। কিন্তু আমার প্রজন্মে আমার সন্তান দুটো। আগে মা-বাবা মনে করতেন, কলেরা আছে, রোগ-ব্যাধি আছে। চিকিৎসা নেই, নানা ঝুঁকি আছে, তাই আরও সন্তান দরকার। এখন তো চিকিৎসা, নানা ধরনের উন্নত ব্যবস্থা আছে। এই কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে- এখন বেশি লোকের দরকার নেই। দরকার 'কোয়ালিটি' মানুষ।

আমাদের দেশের সমস্যা কী? আমি এক কথায় দেশের সমস্যা বলে দিতে পারি। সেটা হলো, প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুলের শিক্ষার সমস্যা। এসব শিক্ষায় 'কোয়ালিটি' এডুকেশন হচ্ছে না। 'স্কিল ডেভেলপমেন্ট' হচ্ছে না। ক্লাস টেনের পর শিশুরা স্কিল ডেভেলপমেন্টের দিকে যাবে। যারা ব্রিলিয়ান্ট তারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যাবে। তাহলেই শিক্ষা ও উন্নয়ন টেকসই হবে।

লেখক : ইকবাল মাহমুদ, চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023369789123535