সনদ জালিয়াতি করে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি |

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন মশিউর রহমান। অল্প দিনেই বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে সখ্যতার দরুন ২০১০ সালে এইচএসসি পাশের সনদ ব্যবহার করেই বিভাগটির তবলা সহায়ক (বাদক) পদে পেয়ে যান চাকুরী। বর্তমানে পালন করছেন সঙ্গীত বিভাগের ডেমোনস্ট্রেটর (তবলা) এর দায়িত্ব।

জানা গেছে, বিভাগের এক শিক্ষকের সুপারিশেই চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। যার সত্যতা মিলেছে সে সময়ের বিভাগীয় প্রধান ড. রশিদুন নবীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভেতরে হওয়ায় কেউ আসতে চাইতো না। তখন তবলা বাদকের জন্যে সার্কুলার দেয়া হলে সেসময় বিভাগের সহকর্মী শাকিল হাসমী আমায় বলেন মশিউরকে চাকুরিটা দেয়া যায় কিনা ব্যবস্থা করতে। তিনি (শাকিল হাসমী) বলেন ছেলেটা (মশিউর) অস্বচ্ছল, ভালো তবলা বাজায়, ওকে চাকুরিটা দিলে উপকার হবে। আমি সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলি এবং সকলে এক সিদ্ধান্তে এসেই চাকুরী দেয়ায় উত্তীর্ণ হয় মশিউর। একটা সময় পর মশিউর ছাত্রত্বও বাতিল করে নেয়।

এদিকে ছাত্রত্ব বাতিল করে চাকরি করায় এইচএসসি পাশের বাইরে আলাদা শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো না মশিউর রহমানের। তবে নিষিদ্ধ হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইবাইস ইউনিভার্সিটি’ থেকে আইনে স্নাতক সম্পন্ন করার সনদ জমা দিয়েছিলেন এই কর্মকর্তা। আপগ্রেডেশন পেয়ে হয়েছেন ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা ডেমোনস্ট্রেটর (তবলা)।

তবে জমা দেয়া সনদের কোথাও লেখা নেই অর্জিত জিপিএ এবং রেফারেন্স। এমন কি ব্যক্তিগত নথিতেও জমা নেই একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট। সনদে স্নাতক পাশের কথা লেখা থাকলেও নেই তার ব্যাপ্তিকাল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সনদটি জালিয়াতি করে বানানো। কারণ সনদে পাসের সাল দেখানো হয়েছে ২০১৪। এই সময়ে সঙ্গীত বিভাগেই কর্মরত ছিলেন মশিউর রহমান। চাকুরীতে থেকে কোনোভাবেই স্নাতক করা সম্ভব নয়। তাছাড়া তাকে কোনো অনুমোদনও দেয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার ও বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সিনিয়র ডেমোনস্ট্রেটর পদে পদোন্নতির জন্যে বিভাগে আবেদন করলে বিভাগটির প্ল্যানিং কমিটি তা আটকে দেয়। প্ল্যানিং কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সনদটি দেখে আমাদের কাছে সন্দেহ লেগেছে। যার কারণে তার কাছে ট্রান্সক্রিপ্ট চাই আমরা এবং সেটি সে এখনো দিতে পারেনি। তাই প্ল্যানিং কমিটি তার আবেদন গ্রহণ করেনি। সভায় তার ব্যক্তিগত নথির সন্ধান চাইলেও তা হারিয়ে গেছে বলে বিভাগকে জানানো হয় বলেও নিশ্চিত করেছে বিভাগটির প্ল্যানিং কমিটির সূত্র।

সঙ্গীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. জাহিদুল কবীর বলেন, আপগ্রেডেশনের জন্যে আবেদন করেছিলো মশিউর। জমা দেয়া সনদ ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ায় তা প্লানিং কমিটি গ্রহণ করেনি। তবে এর সংকট আছে কিনা সেটি দেখবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরীবিধি অনুযায়ী, ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা হতে হলে তাকে স্নাতক পাস হতে হবে। তবে মশিউর রহমান সেই নিয়মকে পরোয়া না করেই ৩য় শ্রেণি কর্মচারী থেকে হয়েছেন ২য় শ্রেণির কর্মকর্তা। তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ ডেমোনস্ট্রেটর মশিউর রহমান।

তিনি বলেন, আমি এইচএসসি পাস করেই তবলা বাদক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেছি। পদন্নোতি পেয়ে হয়েছি ডেমোনস্ট্রেটর। আর এখানে আমার মূল সনদ রয়েছে। এটি জালিয়াতি করা নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছে আমার পাস করার অনেক পরে। সনদে জিপিএ’র সংখ্যা উল্লেখ নেই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাইল। এভাবেই হয়।

সনদের বিষয়ে জানতে ইবাইস (ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ইউনিভার্সিটি) ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে যোগাযোগের ঠিকানায় যোগাযোগ করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

তবে মশিউর রহমান শুরুতে এটি স্বাভাবিক স্নাতক পাস বললেও সুর বদলে তিনি বলছেন এটি উইকেন্ড প্রোগ্রামের আন্ডারে করেছেন। তবে স্নাতক পর্যায়ে এই উইকেন্ড চালুর সত্যতা মেলেনি। এমনকি মশিউর রহমানের উপস্থাপন করা সাময়িক সনদের কোথাও এই প্রোগ্রামের কথা উল্লেখ নেই।

সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. রশিদুন নবী বলেন, তার পড়াশোনা করার বিষয়ে আমি অবগত নই। বিভাগেই লোকবল কম ছিলো, সে এর মধ্যে কোন সময়ে এসব করেছে সেটা আমাদের জানা নেই।

সঙ্গীত বিভাগের একজন শিক্ষক গণমাধ্যমকে বলেন, মশিউর রহমান যদি স্নাতক সম্পন্ন করে থাকেন তবে তাকে অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তাহলে সেটি কখন কিভাবে করেছে? এই প্রশ্ন থেকেই সনদের ধরন কি তার উত্তর পাওয়া যায়। আর বিভাগ তার পড়াশোনার বিষয়ে অবগত নয়। তাই আমাদের প্ল্যানিং কমিটিও বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে তার আপগ্রেডেশন সংশ্লিষ্ট সুপারিশ আটকে রেখেছে। 

সনদ জালিয়াতির বিষয়ে রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আসলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিভাগই মূলত এ সকলক্ষেত্রে সুপারিশ করে। এর আগে কিভাবে পেলো সেটিও যাচাই করে দেখতে হবে। বিভাগ এবিষয়ে আমাদের জানালে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শুধু সনদ জালিয়াতি নয়, সঙ্গীত বিভাগের ডেমোনস্ট্রেটর মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ - dainik shiksha গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য - dainik shiksha হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050938129425049