সন্তানের মুখে বইয়ের প্রতিটি পাতার গল্প শুনতে চান অভিভাবকরা

মিলন কর্মকার রাজু |

পটুয়াখালী জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা, প্রাক প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার সফলতা, ব্যর্থতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন পটুয়াখালী থেকে মিলন কর্মকার রাজু

দৈনিকশিক্ষার পাঠকের জন্য আজ রোববার (২১শে জানুয়ারি) প্রথম পর্ব তুলে ধরা হলো। আগামীকাল সোমবার (২২শে জানুয়ারি) থাকবে প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব।

ওরাও এখন স্বপ্ন দেখে আগামীর। যেখানে থাকবে না “অক্ষর” না জানার অভিশাপ। ঘরের পড়ার টেবিলে রাখা জাল, কোদাল,খোন্তা সরিয়ে অভিভাবকরা সেখানে সাজিয়ে রাখতে চান মোটা মোটা বই। যে বই পড়ার সৌভাগ্য তাদের হয়নি, সেই বইয়ের প্রতিটি পাতার গল্প শুনতে চান সন্তানের মুখে। নিরক্ষতার অভিশাপ মুক্ত করতে চান ভবিষৎ প্রজন্মকে।

এ স্বপ্ন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অবহেলিত সাগর ঘেষা পশ্চিম চাপলী গ্রামের পিছিয়ে পড়া জেলে জনগোষ্ঠীর। এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে তাদের ভবিষৎ প্রজন্ম। গত নয় বছরে “চাঁদের হাসি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’র” শিক্ষাপ্রীতি পাল্টে দিয়েছে এ গ্রামের অভিভাবকদের শিক্ষাভীতি। কাজ নয়, শিক্ষাই গড়ে দেবে ভবিষৎ এ শ্লোগানে উদ্ধুদ্ধ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অভিভাবকদের আন্তরিকতায় এখন এখানকার প্রতিটি শিশু স্কুলমুখী। চাঁদের হাসিতে হাসছে উপকূল, বপন হচ্ছে আগামীর স্বপ্ন।

শুরুটা ২০০৮ সালে। সিডর বিধ্বস্ত কলাপাড়ার উপকূলের মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিলো উন্নয়ন সংস্থা এফএইচ। ক্ষুধা, দারিদ্র ও অভিভাবকদের অসচেতনতায় তখন “শিক্ষা দূর্ভিক্ষ” উপকূলের সিডর থাবায় বিধ্বস্ত প্রতিটি পরিবারে। এ শিক্ষা দূর্ভিক্ষ থেকে শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে কলাপাড়ায় ধুলাসার ইউনিয়নে চারটি ও নীলগঞ্জ ইউনিয়নে তিনটি মোট সাতটি “শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র” গড়ে তোলা হয়। তাদের আন্তরিকতায় গত নয় বছরে এ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার শিশু এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত।
“ চাঁদের হাসি, শিশুকুঞ্জ, দিগন্ত, কাউয়ার চর, সোনামনি, বন্ধন ও গোলাপ” শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র উপকূলের শিশুদের প্রি-স্কুল। উপকূলের যে অভিভাবকরা এতো বছর শিশুদের শিক্ষার পরিবর্তে শৈশবেই নানা কর্মের তালিম দিতো, সেই অভিভাবকদের সচেতন করে তাদের সন্তানদেরই অক্ষর শিখিয়ে স্কুলগামী করতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কাজ করছে।

কলাপাড়া সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সাগর ঘেষা একটি গ্রাম পশ্চিম চাপলী। শহরের উন্নয়ন ছোঁয়ার ছিটিফোটাও নেই এখানে। এখনও সংকট বিশুদ্ধ পানির। গ্রামীণ এবড়ো থেবড়ো রাস্তা। সন্ধা হলেই অন্ধকারে ঢেকে যায় গোটা গ্রাম। সেই অন্ধকারে চাঁদের আলো শিক্ষার আলোতে এখন গোটা গ্রাম আলোকিত করছে । গত নয় বছরে শুধু এ গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ঝড়ে পড়া দুই শতাধিক শিশু এখন স্কুলগামী।

চাঁদের হাসি’তে গিয়ে দেখা যায়, কেউ পড়ছে অ আ কেউবা ছড়া। কেউ আবার গুনছে এক,দুই কেউবা পড়ছে বারো মাসের নাম। হাসি-আনন্দ ও উচ্ছাস নিয়ে চার-পাঁচ বছরের এ শিশুরা পড়ালেখায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। অথচ মাত্র নয় বছর আগে এই বয়সী শিশুরা কেউ মাঠে ধান কুড়াতো, কেউবা বাবা-মায়ের সাথে শ্রম পেশায় যেতো বর্গা খাটতে।

পাঁচ বছরের ইউনুস। তার জন্মের সময়েই মায়ের মৃত্যুর পর খালার কাছে থেকে বড় হচ্ছে। বাবা দিনমজুর সালাম মোল্লা দ্বিতীয় বিয়ে করে এখন সংসার করছে। এ চাঁদের হাসিতে ইউনুস শিখছে প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষা। আদর্শ লিপি শেষ হয়েছে। এবার স্কুলে ভর্তি হবে সে।

এ শিক্ষা কেন্দ্রের সেবিকা (শিক্ষিকা) নিপুন আক্তার জানান, নতুন বছর ১৯ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। মাসিক মাত্র ২০ টাকায় তাদের স্কুলগামী করে তোলা হচ্ছে।

শিশু জিদনী, সাহাদাত, জান্নাতী, রিয়াজ, মাছুমও এখানকার শিক্ষার্থী। বাবা-মা অক্ষর না চিনলেও মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সেই ওরা গলা ছেলে আবৃতি করছে ছড়া, কবিতা। বর্ণমালা দেখে শব্দ তৈরি, কিংবা ইংরেজি সপ্তাহ, মাসের নামও বলে দিচ্ছে। সন্তানের এ শিক্ষার আগ্রহ কাছ থেকে দেখে চোখের জল ফেলছে অভিভাবকরা।
লিজা(৫)। জেলে মো. লিটনের ছোট মেয়ে। আরও তিন সন্তান আছে তার। তাদের কাউকেই স্কুলে ভর্তি করতে পারেন নি আর্থিক দৈন্যতায়। গ্রামের স্কুলের পাশ দিয়ে যখন যেতেন তখন তার চোখে জল চলে আসতো নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে। তাই ছোট মেয়ে লিজাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন নিয়ে এ চাঁদের হাসিতে ভর্তি করিয়েছেন।

ট্রলার শ্রমিক মো. ইউসুফেরও চার সন্তান। নিজে অক্ষর জানেন না। আর্থিক দৈন্যতায় তিন সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তিনিও ছোট মেয়ে সুমাইয়াকে চাঁদের হাসিতে নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন,“ মোরা কাম করছি প্যাডের খিদায়। ঘরের টেবিলে কোনদিন বই খাতা দেহি নাই। হারা ঘরে জালের কাডি, লাঙ্গলের ফাল, খোন্তা-কোদাল। এই মাইয়ারে ল্যাহাপড়া করামু। ঘরের টেবিলে এ্যাহন বই সাজামু। মোডা(মোটা), মোডা বই থাকবে। মাইয়ায় বড় হইয়া হেই বইয়ের গল্প মোগো হুনাইবে। এভাবে নতুন বছরে উপজেলার সাতটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে দুই শতাধিক শিশু ভর্তি হয়েছে আগামীর উজ্জল ভবিষতের স্বপ্ন নিয়ে।

এফএইচ’র শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের টিম লিডার আসাদুল ইসলাম জানান, স্কুল ঘর তৈরি থেকে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয় তাদের সংস্থা থেকে। এছাড়া প্রতিটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে চক, শ্লেট, শিক্ষার ফ্লিপচার্ট ও খেলায় খেলায় শিক্ষা ও জানার জন্য খেলার উপকরণ দেয়া হয়েছে। তাদের লক্ষ্য গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা যাতে সাবলম্বী পরিবারের শিশুদের থেকে পিছিয়ে না পড়ে এজন্য শিক্ষায় মনোযোগী করে তোলা।

এফএইচ’র এরিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর গৌতম দাস জানান, ২০০৮ সাল থেকে কলাপাড়ায় সাতটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে কয়েক হাজার শিশু শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে। গ্রামে নিশ্চিত ঝড়ে পড়া শিশুকে স্কুলগামী করে তোলাই তাদের সাফল্য।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ - dainik shiksha ১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004971981048584