সবাই অটোপাস পেলে মেধার কী হবে

মাছুম বিল্লাহ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

একবার আমার এক সাবেক সহকর্মী প্রার্থীদের পড়শোনার দৌড় দেখে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এরা কি কিছুই পড়ে না, ক্লাস একেবারেই করে না? যদি ক্লাস করতো এবং নিজ বিষয় সম্পর্কে একটু জ্ঞান থাকতো তাহলে তো বোর্ডে এসব গাঁজাখুরি গল্প বলতো না। 

ঘটনা আসলেই তাই। ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন না, করতে চান না, কিছু জানতে চান না। যদিও এজন্য কেবল তারাই দায়ী নন। দায়ী কমবেশি আমরা সবাই। সবচেয়ে বেশি দায়ী শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা। তারা পাসের হার বাড়ানোর জন্য খাতায় কিছু না লিখলেও পাস করানোর কথা বলে এসেছেন। ফলে, জাতি প্রায় মেধাশূন্যতার দিকে যাচ্ছিলো। এটিকে ফেরানো দরকার। যাতে সস্তা জনপ্রিয়তার বিনিময়ে জাতি পুরোপুরি ধ্বংস না হয়।  

সম্প্রতি আমরা দেখেছি, সচিবালয়ে তুলকালাম বাধিয়ে পরীক্ষা শেষ না করেই পাসের অধিকার আদায় করে নিয়েছেন এইচএসসি পরিক্ষার্থীরা। এবার অটোপাসের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত রোববার দুপুরে গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে এই কর্মসূচি পালন করেন তারা। পরে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা ‘ডিগ্রি বৈষম্য নিরসন ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে এ কর্মসূচি পালন করেন। তাদের অভিযোগ, সেশনজটের কারণে এবং সময়মতো পরীক্ষা না নেয়ায় তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা ৬/৭ বছরেও ফাইনাল পরীক্ষার চূড়ান্ত ধাপ শেষ করতে পারেননি। এ কারণে তারা হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাই তাদের দাবি, ডিগ্রি শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে এবং ডিগ্রি প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ফলাফলের ভিত্তিতে তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। 

তারা বলেন, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে অবহেলিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কোর্সের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ডিগ্রি থেকে বিসিএস বা ভালো চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য দুই বছরের মাস্টার্স করা প্রয়োজন হয়। এটাও বৈষম্য। 

কিন্তু, আপনারা যে প্রশ্ন তুলেছেন উত্তর তার মধ্যেই লুক্কায়িত আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে সবারই প্রশ্ন, মান নিয়ে সবারই আক্ষেপ। চাকরির বাজারে কদর কম। এখন আপনারা যে দাবি তুলছেন, সেটিতে তো এই প্রশ্নগুলো আরো বড় করে সামনে আসবে। কেনো আপনারা নিজেদের ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন? বরং নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ করার সুযোগ নিন। অযথা বিনাশ্রমের, বিনাকষ্টের, সস্তা ডিগ্রি নিয়ে কি করবেন? চাকরির ইন্টারভিউতে ভালো করার জন্যও আপনাদের পড়াশুনা করা দরকার, একাডেমিক পরীক্ষার প্রস্ততি নিতে যে সময়টুকু ব্যয় করবেন সেটি আপনার চাকরি প্রাপ্তির জন্যই ভালো হবে। চাকরিরত থাকলে প্রমোশনের জন্য সুবিধা হবে। চাকরি দাতারা যখন দেখবেন এবং জানবেন, অটোপাস করা প্রার্থী তখন তাদের আগ্রহ কিন্তু হঠাৎ করেই ফল করবে।  

আমাদের চাকরির বাজারে লাখ লাখ ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান চাকরি করছেন। এর কারণ শুধু রাজনৈতিক নয়, যোগ্যতা, দক্ষতা, একাগ্রতা আর ভাষাজ্ঞান ও ভাষার ব্যবহার। আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখছি, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় শিক্ষার কি হাল হয়েছে। একজন শিক্ষার্থীর কথা বলা, উপস্থাপনা, বিষয়জ্ঞান, ইংরেজিতে কিছু বলা ও লেখা, কম্পিউটার চালনায় দক্ষ হতে হয়। এগুলো না হলে চাকরিদাতারা প্রার্থীদের চাকরি দেবেন কেনো? আর এগুলো সবই অধ্যবসায় দিয়ে, কষ্ট করে, গভীর অনুশীলন করে অর্জন করতে হয়, এমনিতেই হয় না। আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব পরিশ্রমের ধারে কাছেও যেতে চান না। ফলে চাকরির বাজার যাচ্ছে অন্যদের দখলে। এখনো আমরা বিষয়টি বুঝতে চাই না। 

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আরো জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই নিয়মিত, অনিয়মিত, প্রাইভেট ও সার্টিফিকেট কোর্সের এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জীবিকার তাগিদে পড়ালেখার পাশাপাশি অনেকেই কাজ করেন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য অনেক সময় চাকরিও ছেড়ে দিতে হয় তাদের। এটি একটি যুক্তিযুক্ত কথা। ডিগ্রি কোর্সে যারা ভর্তি হন এবং যারা চাকরিজীবী তাদের পরীক্ষার সময় একটু আলাদা হওয়া প্রয়োজন। সেই বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে যৌক্তিকভাবে জানালে তারা শুনতে পারেন। আপনারা বিষয়টি নিয়ে দাবি জানাতে পারেন। কিন্তু এসব কারণে পরীক্ষাতে না বসে সার্টিফিকট নেয়ার ধারণাটা কোনো যৌক্তিক বিষয় নয়। এটি কেউই ভালো চোখে দেখবেন না, দেখার কথা নয়। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, অনেকে চিকিৎসাধীন, অনেকেট ট্রমার মধ্যে আছেন। কিছুদিন আগে বন্যায় আক্রান্ত হয়ে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এগুলো সবই বাস্তব ও যুক্তির কথা। দেশের পট পরিবর্তনের ফলে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা একটি নাজুক সময়ে সচিবালয়ে ঢুকে একটি অনৈতিক দাবি আদায় করে নিয়েছেন। পরীক্ষা না দিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হবে। এটি আমরা কেউ মনেপ্রাণে মেনে নিইনি। শিক্ষার্থীরা যে ভুল করেছেন, তার ফল তাদের ভোগ করতে হবে। সাময়িক সুবিধার জন্য তারা যা করেছেন, সেটি উচ্চ মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীও চাননি। তাদের দেখাদেখি ডিগ্রির শিক্ষার্থীদেরও অটোপাস দিতে হবে, এভাবে সব অনৈতিক দাবি নিয়ে সবাই এগোলে দেশের কী হবে? 

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে কেন লটারি - dainik shiksha প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে কেন লটারি এসএসসি ২০২৫-এর ফরম পূরণ ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫-এর ফরম পূরণ ১ ডিসেম্বর কওমি ও আলিয়া মাদরাসার প্রাচীর উঠিয়ে দিতে হবে - dainik shiksha কওমি ও আলিয়া মাদরাসার প্রাচীর উঠিয়ে দিতে হবে শাবাশ অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও দেশপ্রেম - dainik shiksha শাবাশ অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও দেশপ্রেম এইচএসসির ফল তৈরিতে নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এইচএসসির ফল তৈরিতে নতুন নির্দেশনা অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট - dainik shiksha অধ্যক্ষ মাহবুব মোল্লাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এসএসসি ২০২৫ -এর টেস্টের ফল ২৭ নভেম্বরের মধ্যে - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ -এর টেস্টের ফল ২৭ নভেম্বরের মধ্যে এসএসসির নম্বরের ভিত্তিতে হবে বাতিল এইচএসসির ফল - dainik shiksha এসএসসির নম্বরের ভিত্তিতে হবে বাতিল এইচএসসির ফল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053088665008545